‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারেনি’
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারেনি। কারণ রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। রাজনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে রাষ্ট্র এটিকে খুব পছন্দ করেছে তা নয়। কারণ ইংরেজবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শত্রুতা লেগে গেল। পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালো চোখে দেখেনি।’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যাতে রাজনীতি করতে না পারে তার জন্য রাষ্ট্র তৎপরতা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে রাষ্ট্র যেটা করল সেটা ভয়ঙ্কর। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে । প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণ করে ছাত্র-শিক্ষক হত্যা করেছে। তারপর তারা বেছে বেছে শিক্ষকদের হত্যা করেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় এসব কথা বলছিলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেন, ‘একাত্তরের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক, তা রাষ্ট্রের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতামূলক হয়নি। এর অন্যতম কারণ রাষ্ট্রের যে পরিবর্তন বা বিকাশ ছিল, শিক্ষার্থীরা তা সমর্থন করতে পারেনি। এটা হলো একটা দিক। আরেকটা দিক হলো এই বিশ্ববিদ্যালয় যে দায়িত্ব পালন করেছে সেটা হলো সামাজিক দায়িত্ব। কেননা পূর্ববঙ্গের একটা সমাজ ছিল পশ্চাৎপদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছিল এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আরেকটা কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে করেছে। সেটা হচ্ছে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশকে সাহায্য করেছে। এই শ্রেণি যে কেবল মুসলমান মধ্যবিত্ত তা নয়, হিন্দু মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। এই মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটানোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি ভূমিকা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি অসাম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি দিক হচ্ছে এটি সবময় ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। যখন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা ছিল তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সেটি ছিল না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক জীবনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। আবাসিক হলগুলোতে সামাজিক জীবন গড়ে উঠবে, ছাত্রদের মধ্যে আদান-প্রদান হবে এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যেও আদান-প্রদান হবে। কারণ শিক্ষকরাও এই হলগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আর এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল।’
ছাত্র সংসদের কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংসদের মধ্য দিয়ে ছেলে-মেয়েরা মেধা বিকাশের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে। সংস্কৃতি চর্চা করতে পারে, খেলাধুলা করতে পারে, লিখতে পারে, বক্তৃতা করতে পারে। এই যে সুযোগগুলো আবাসিক হল কেন্দ্রিক ছিল, আর এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত ছাত্র সংসদ। এক সময় ছাত্র সংসদের নির্বাচন উৎসবের মতো ছিল। এটা বৃটিশ, পাকিস্তান আমলেও ছিল। স্বাধীন হওয়ার পরে সামরিক শাসনামলেও ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ১৯৯১ সালের পরে ছাত্র সংসদে নির্বাচন আর নিয়মিত হয় না। একবারই হলো কিন্তু সেটাও খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই যে সামাজিক বলয়ে থাকা, সেটাও জ্ঞানের চর্চায় একটা ভূমিকা রাখে। কারণ জ্ঞান তো কেবল দিলেই হবে না, ছাত্রদের গ্রহণও করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু কোনো সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সমাজে যে জ্ঞানের মূল্য কমে গেছে, জ্ঞান ছাড়াই যে উন্নতি সম্ভব এবং জ্ঞান যে মর্যাদা পাচ্ছে না, সেই বাস্তবতাও কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিফলিত।’
ছাত্রদের জ্ঞান গ্রহণের আগ্রহ কমার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের জ্ঞান গ্রহণ করার যে আগ্রহ সেটাও কিন্তু কমে গেছে। আর এই আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ হলো শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক আগের মতো নেই। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করলে জীবিকার একটা সংস্থান হতো। বাংলাদেশ হওয়ার পর উন্নতি হয়েছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। ফলে তরুণরা ভয় পায় যখন তারা বের হবে বোধহয় বেকারত্বের মধ্যে পড়বে, আর তারা পড়েও।’
আল সাদী ভূইয়া/এমএইচআর/এএসএম