রাবিতে নাটকীয় নিয়োগের ‘নেপথ্যে’ ৩ কারিগর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) থমথমে অবস্থার মধ্যেই বৃহস্পতিবার (৬ মে) দুপুরে বাসভবন থেকে বের হয়ে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। উপাচার্যকে বহনকারী গাড়ি বাসভবনের সীমানা অতিক্রম না করতেই দলে দলে বাসভবনে প্রবেশ করতে থাকেন চাকরিপ্রত্যাশীরা।
সেখানে উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বেলাল হোসাইন জানান, বাসভবনের ভেতরে আগে থেকেই উপাচার্যের স্বাক্ষরকৃত নিয়োগ তালিকা তৈরি করা ছিল। ইস্যু করা ছিল নিয়োগ আদেশের চিঠি। নিয়োগ তালিকা ধরে ইস্যুকৃত চিঠিগুলো বিলি করছিলেন তারিকুল নামের একজন। চিঠিগুলো নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফা, টি-টেবিল এবং মেঝে যে যেখানে পেরেছেন চিঠিতে স্বাক্ষর করতে শুরু করেন। এরপর জমা দিচ্ছিলেন মামুন অর রশীদ নামের একজনের কাছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার নিয়োগকার্য বাস্তবায়নের পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখেন এই দুইজনসহ তিনজন। এদের মধ্যে তারিকুল ইসলাম হলেন রেজিস্ট্রার শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার আর মামুন অর রশীদ পরিষদ শাখার কর্মকর্তা।
চিঠিতে স্বাক্ষর করতে রেজিস্ট্রারের ‘না’
এদিন সকালে নিয়োগের জন্য ইস্যুকৃত চিঠিতে স্বাক্ষরের জন্য রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালামকে উপাচার্য বাসভবনে ডাকা হয়। তার জন্য গাড়ি পাঠানোর প্রস্তাব করেন স্বয়ং উপাচার্য। তখন অবৈধ নিয়োগের বিষয়টি টের পেয়ে অজানা স্থানে চলে যান বলে জানান অধ্যাপক সালাম এবং চিঠিগুলোতে স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানান।
এ প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অবৈধ এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব কিছু প্রস্তুত করা হয়েছে আগেই। অবৈধ নিয়োগ কার্যক্রম ও সরকারি নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত হতে চাইনি, তাই (উপাচার্য) ডাকলেও সেখানে উপস্থিত হইনি। নিজ বাসা থেকে বের হয়ে অজ্ঞাত জায়গায় চলে যাই। কারণ বাসায় থাকলে তুলে এনে স্বাক্ষর করানো হতো বলে দাবি জানান অধ্যাপক সালাম।
রেজিস্ট্রার বলেন, তার অনুপস্থিতিতে উপাচার্যের নির্দেশে সব চিঠিতে স্বাক্ষর করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন (কর্মকর্তা) শাখার প্রধান ইউসুফ আলী। তিনজনের বাকি একজন হলেন এই কর্মকর্তা।
ছেলেকে নিয়োগ দিতে বদলি স্বাক্ষর
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, অন্য রেজিস্ট্রাররা যখন স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানান সেখানে ইউসুফ আলী উপস্থিত হয়ে স্বাক্ষর করে চিঠিগুলো ইস্যু করেন। রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর না করলেও তিনি নিজে স্বাক্ষর দেয়ার স্বার্থ ছিল ছেলেকে চাকরি পাইয়ে দেয়া।
নিয়োগ তালিকা থেকে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদে ৮৫ জনের তালিকার ৮২ নম্বরে আছেন সংস্থাপন শাখার এই ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইউসুফ আলীর ছেলে নাহিদ পারভেজ। সিনিয়র সহকারী পদের বিপরীতে নিম্নমান সহকারী হিসেবে সংস্থাপন শাখায় নিয়োগ পেয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে ইউসুফ আলীর মোবাইলে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
আদেশ পালনের নেপথ্যে ভাইয়ের নিয়োগ
গত ৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকরা অভিযোগ করেন, ৩ মে রাতে উপাচার্যের জামাতা শাহেদ পারভেজের নেতৃত্বে সিনেট ভবন থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো চুরি করা হয়। ওইদিন পরিষদ শাখার মামুন অর রশীদসহ কয়েকজন ভিসি জামাতাকে সহযোগিতা করেন। নথিগুলো সিনেট ভবন থেকে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন মামুন অর রশীদ। তবে সেটি চুরি নয় বলে দাবি তার।
কিন্তু রাতের বেলা নেয়ার কারণ জানতে চাইলে মামুন অর রশীদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করলে ২৪ ঘণ্টায়-ই অফিস। উপাচার্য নির্দেশ দিয়েছেন নথিগুলো নেয়ার জন্য, তাই নিয়েছি। তাতে রাত আর দিন নেই। নির্বাহী আদেশ পালন করেছি।’
বৃহস্পতিবার (৬ মে) চাকরিতে যোগদানের স্বাক্ষরকৃত ফরমগুলোও পরিষদ শাখার এই কর্মকর্তার কাছে জমা দিচ্ছিলেন নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা।
অন্যদিকে উপাচার্য বাসভবনে নিয়োগ তালিকা ধরে যিনি চিঠি বিলি করছিলেন তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল আলম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সে বিষয়ে জানতেন কি-না, প্রশ্ন করলে তারিকুল আলম বলেন, ‘এটা তো আমাদের জানার কথা না। ওপর মহলের ব্যক্তিরা জানেন। আমরা আদিষ্ট হয়ে কাজ করেছি।’ তিনি জানান, সকালে নিয়োগের এই কাজগুলো করার জন্য ভিসি বাসভবনে ডাকা হয় তাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অন্য কোনো কর্মকর্তা না আসলেও এই দুই কর্মকর্তার আদেশ পালনে উৎসাহী হওয়ার নেপথ্যে ছিল তাদের দুই ভাই। তারিকুল আলমের ভাই মাসুম আল শামীম নিয়োগ পেয়েছেন প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের নিম্নমান সহকারী হিসেবে। নিয়োগ তালিকার ৭৫ নম্বরে আছে তার নাম। ভাইয়ের নিয়োগ দলীয় পরিচয়ে বলে দাবি করেন তারিকুল আলম।
আর তালিকার ৬৮ নম্বরে থাকা শেখ ফারহানুল ইসলাম পরিষদ শাখার কর্মকর্তা মামুন অর রশীদের ভাই বলে জানা গেছে। তবে ভাইয়ের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি মামুন অর রশীদ।
নিয়োগ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে জড়িত এই তিন ব্যক্তিকে উপাচার্যের অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গী হিসেবে উল্লেখ করছেন শিক্ষকরা। তাদের শাস্তির আওতায় আনারও দাবি তুলেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সুলতান উল ইসলাম বলেন, ‘সবকিছু জানার পরও তারা সহযোগিতা করেছেন। উপাচার্যের অবৈধ কার্যক্রমে যুক্ত থাকার কারণ আত্মীয়দের চাকরি পাইয়ে দেয়া।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘শেষ কার্যদিবসে নিয়োগ দেয়ার আট ঘণ্টার ব্যবধানে নিয়োগগুলোকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে আমরা এই আশঙ্কাগুলোর ব্যাপারে আগে থেকেই বারবার বলেছি। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি। তবে তারা দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এই দুঃসাহস দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। এতে করে জাতির সামনে মুখ দেখানোর অবস্থা শিক্ষকদের নেই।’
মেয়াদ শেষে ক্যাম্পাস ত্যাগের আগে অ্যাডহকে শতাধিক চাকরিপ্রত্যাশীকে নিয়োগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। এরমধ্যে উপাচার্য স্বাক্ষরিত একটি তালিকা জাগো নিউজের হাতে এসেছে।
উপাচার্য স্বাক্ষরিত ওই নিয়োগ তালিকায় শিক্ষক পদে ৯ জন, কর্মকর্তা পদে ১৯ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পদে ৮৫ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে ২৪ জনের নাম।
নিয়োগের বিষয়ে জানতে সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সালমান শাকিল/এসআর/এএসএম