লবণসহিষ্ণু সিমের নতুন জাত উদ্ভাবন
অডিও শুনুন
সিমের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরকৃবি) একদল গবেষক। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. গোলাম রসুল। সম্প্রতি জাতীয় বীজ বোর্ড এটি অনুমোদন করেছে।
নতুন বিইউ সিম-৭ জাতটি লবণসহনশীল ও উচ্চফলনশীল হওয়ায় বাংলাদেশের বিস্তৃত দক্ষিণাঞ্চলে শীত মৌসুমে পতিত থাকা জমির সুষ্ঠু ব্যবহার ও অধিক পরিমাণ সবজি উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
প্রফেসর ড. মো. গোলাম রসুল জানান, নতুন উদ্ভাবিত এ জাতে গাছপ্রতি ২ দশমিক ৪ থেকে ৩ দশমিক ৫ কেজি সিম উৎপাদিত হয়। সেই হিসেবে হেক্টর প্রতি সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ফলনশীলতা ৩৫ টন।
তিনি বলছেন, ১২ ডিএস/এম লবণাক্ততা সহনশীল হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলাসহ সারাদেশে আবাদ করা সম্ভব এই জাতের সিম। তিনি আরও বলেন, বিশ্বে টাটকা সবজিতে ০.৫ থেকে ৩২.০ মাইক্রোগ্রাম/গ্রাম অ্যান্থসায়নিন পাওয়া যায়। তবে নতুন এই জাতটিতে উচ্চমাত্রায় অ্যান্থসায়ানিনের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে।
অ্যান্থসায়নিন হলো পোলিফেনোলিক রঞ্জক যা পরাগায়নে সাহায্যকারী পতঙ্গ এবং বীজ বিস্তারককে আকর্ষণ করে ফসলের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গাছকে সুরক্ষায় ভূমিকা রাখে। শাকসবজিতে প্রাপ্ত অ্যান্থসায়নিন মানবদেহের ভাস্কুলার প্রদাহ হ্রাস এবং থ্রম্বোসিস (রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা) প্রতিরোধে যথেষ্ট কার্যকরী বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃত।
প্রফেসর ড. মো. গোলাম রসুল জানান, প্রায় সব জাতের সিমই জাব পোকা এবং জ্যাসিড দ্বারা আক্রান্ত হয়। শীতের অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে সিমের প্রধান পতঙ্গ শত্রু। অর্থাৎ এফিড এবং জ্যাসিড মাত্রাতিরিক্তভাবে বংশবিস্তারের কারণে ফসলটি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে ফলন কমে যায়, যা থেকে নতুন জাতটি প্রতিরোধী।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে রোপণ করলে ১৩০ দিনে ভক্ষণযোগ্য ফল সংগ্রহ করা যায় নতুন জাতের এই সিম থেকে। তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরও ২০ দিন সময় বেশি লাগবে।
সিমের জাতটি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া বলেন, ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে টেকসই উন্নয়ন বজায় রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন জাতের এই সিম উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিপ্লব ঘটাতে সম্ভব হবে বলে আশা করি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে ২০ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪৪ হাাজর ৫০ টন সিম উৎপাদিত হচ্ছে (বিবিএস, ২০২০)। দেশের প্রায় সব জাতগুলো মৌসুমের একই সময়ে ফলন দেয় এবং বেশিরভাগ চাষি একই সময়ে তাদের সিম বাজারে নিয়ে আসেন। এতে করে সিমের বাজারমূল্য হ্রাস পায়। তাছাড়া খরা, লবণাক্ততা, অতিবৃষ্টি, পোকামাকড় (এফিড) বা রোগবালাইয়ের আক্রমণে উৎপাদন কমে যায়।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৩৭% উপকূলীয় এলাকা। ওই এলাকাতে চাষ উপযোগী সবজি তথা সিমের অনুমোদিত উফশি তেমন জাত নেই। এমতাবস্থায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, টেকসই খাদ্য উৎপাদন বজায় রাখা এবং খরা, অতিবৃষ্টি ও লবণাক্ততার প্রভাব প্রতিরোধসহ বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকায় চাষযোগ্য নতুন জাত উদ্ভাবনই সর্বোত্তম ও বিকল্প উপায় বলে মনে করা হচ্ছে।
উৎপাদন পদ্ধতি
দেশের সব জেলাতে শীত মৌসুমে এই জাতের বীজ রোপণ করা যেতে পারে। গোবর-মাটির মিশ্রণে ভরা (অর্ধেক-অর্ধেক) ছোট পলিথিন ব্যাগে চারা গজিয়ে পরবর্তীতে মাঠে গর্তে লাগানোই ভালো। প্রতি গর্তে ১০ কেজি পচা গোবর, ১০ গ্রাম ইউরিয়া (দুইবারে), ৩০ গ্রাম টিএসপি ও ২০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।
বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা শতকরা ৯০ ভাগ বিবেচনায় নিয়ে প্রতি হেক্টরে ৪.০ থেকে ৫.০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ লাগানোর ১৩০ দিনের মধ্যে সবজি ফসল হিসাবে সিম সংগ্রহ করা যায়। তবে বীজ সংগ্রহের জন্য আরও ২০ দিন সময় বেশি লাগবে। এক কঞ্চি বিশিষ্ট বাউনি বা মাচা চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে এই সিম উৎপাদন করা যায়।
আমিনুল ইসলাম/এসআর/এমএস