সূক্ষ্ম ডিভাইসে অভিনব জালিয়াতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষায় নতুনভাবে চালু হওয়া বারকোডে কিছু সময়ের জন্য ব্যর্থ হলেও তৎপরতা বন্ধ নেই জালিয়াত চক্রগুলোর। জালিয়াতি এড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বার কোডিং পদ্ধতি চালু করলে চক্রগুলোও নিত্য নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। নতুন ব্যবহৃত প্রযুক্তিটি দেখলে কোনো ভাবেই বুঝার উপায় নেই যে এটি একটি ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস। ভর্তি পরীক্ষায় এমনই সূক্ষ্ম ও অত্যাধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখা গেছে। জালিয়াতির ঘটনায় আটক করা হয়েছে হাসিবুল হাসান শামু নামে এক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীকে।
এদিকে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী শামুকে আটক করতে পারলেও ধারণা করা হচ্ছে এমন অসাধু কাজ করে পার পেয়ে গেছেন আরও অনেকেই। এছাড়া বরাবরের মতোই আড়ালে রয়ে যাচ্ছেন জালিয়াত চক্রের মূল হোতারা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও স্বীকার করছে অভিনব এ জালয়াতির চেষ্টার কথা। প্রশাসন বলছেন, ‘জালিয়াতি চক্রগুলো তাদের চেষ্টা অব্যহত রাখছে। তবে যারাই এমন কাজ করছে তাদের ধরতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
শুক্রবার অনুষ্ঠিত ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে আটক করা হয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী হাসিবুল হাসান শামুকে। কেন্দ্রে প্রবেশের সময় গেইট ম্যানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করতে পারলেও হলের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকের চোখে ধরা পড়ে তার জালিয়াতির ধরণটি। পরে হলের পরিদর্শকরা তার কাছ থেকে একটি ডিভাইস জব্দ করেন।
আটকের পর দেখা যায় শামুর কানের ভিতরে অতি ক্ষুদ্র একটি ব্লু-টুথ দেয়া রয়েছে। যা চোখে দেখাও মুশকিল। আর তার প্যান্টের পকেটে একটি এটিএম কার্ডের মতো স্মার্ট কার্ড। এ কার্ডটির মধ্যেই যতসব কারিকুলাম। কার্ডটির মধ্যে একদম সূক্ষ দুটি সুইচ রয়েছে। তাও আবার টাচ এর মতো। এ দুটি দিয়ে পরবর্তী ধাপের কাজ করবে শিক্ষার্থী।
এ প্রযুক্তিটির মাধ্যমে শিক্ষার্থী শুধু শুনবে। কিছু বলতে পারবে না। কানে থাকা ডিভাইসটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে একে একে প্রশ্ন এবং উত্তর বলবে চক্রটি। আর সে শুনে শুনে দাগাবে।
এদিকে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জাগো নিউজকে জানায়, জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো আরেকটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও করছে। এ পদ্ধতিতেও শিক্ষার্থীর কানে থাকবে অতি ক্ষুদ্র একটি ডিভাইস। আর হাতের বাহুতে থাকবে একটি সরু তার। এছাড়া কোমরে থাকবে আরেকটি তার। এটি প্যান্টের ভিতর ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এখানে থাকে একটি ছোট সুইচ। এটি দিয়ে ডিভাইসটি চালু ও বন্ধ করা হয়। এ পদ্ধতিতেও শুধু শুনবে। কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। চক্রগুলো একে একে প্রশ্ন ও উত্তর বলবে। আর পরীক্ষার্থী শুধু সঠিক উত্তরগুলোর ঘর ভরাট করবে। পরীক্ষা শেষে চুম্বকের মাধ্যমে তার কানের ভিতর থেকে ডিভাইসটি বের করা হয়ে থাকে।
চক্রগুলোর পরীক্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নপত্র বের করে নেয় কেন্দ্র থেকে। এরপর ১০ মিনিটের মধ্যে তা সমাধান করে বাকি সময়ের মধ্যে তা আবার ভর্তিচ্ছুদের কাছে প্রযুক্তির ব্যবহারে পাঠায়। কেন্দ্রগুলোতে থাকে তাদের আরেকটি সু-সংগঠিত চক্র। যারা পরীক্ষা শুরুর পরপর তা বাহিরে পাচার করে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের একে একে প্রশ্নপত্রের উত্তর বলা হয়। সেটকোড না থাকায় চক্রগুলোকে একে একে সব প্রশ্ন পড়ে উত্তর বলতে হয়। আর শিক্ষার্থীদেরও কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ একটি প্রশ্ন এক প্রশ্নে ১ নম্বরে থাকলে আরেকটি প্রশ্নে ১০ নম্বর, ১৪ নম্বর প্রশ্নে থাকে। তাই এ পদ্ধতিতে সময়ও অপেক্ষাকিত বেশি লাগে। কারণ প্রতিটি প্রশ্ন এবং উত্তর পড়তে হয়। তবে আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রাখছি। তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও সমানভাবে কাজ করছে চক্রগুলোকে ধরতে।’
আটক হাসিবুল হাসান শামুকে ভর্তি পরীক্ষার সময় দায়িত্বে থাকা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষাসমূহ অপরাধ আইন ৯(খ) ধারায় তাকে এ সাজা দেন ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী মাহবুব।
এর আগে জিজ্ঞাসাবাদে শামু একটি চক্রের কথা জানান। যাদের সঙ্গে ৫ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছে তার। ডিভাইসটি নেয়ার সময় ১০ হাজার টাকা দিয়েছে সে। বাকি টাকা পরীক্ষার পরে দেয়ার চুক্তি ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের সঙ্গে জড়িত ঢাবির দুই শিক্ষার্থীর কথা জানান। তারা দুই জন হচ্ছেন- অমর একুশে হলের ফরহাদ মাহমুদ (আইটি, শেষ বর্ষ) এবং পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শুভ। পরবর্তীতে তাদের আটকের জন্য প্রক্টরিয়াল টিম গেলে হল থেকে পালিয়ে যাওয়ায় তাদেরকে আর আটক করা যায়নি।
এর আগে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফার্মগেট থেকে একজনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর তাকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শুক্রবার দিবাগত রাতে ফার্মগেট, নাখালপাড়া ও তেজকুনি পাড়া থেকে আরো ১১ জনকে আটক করা হয়। এ নিয়ে ঢাবি ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে জালিয়াত চক্রের ১৩ জনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও গোয়েন্দা পুলিশ।
এদিকে, ঢাবি ভর্তি পরীক্ষা শেষে শুক্রবার দুপুর দুইটার দিকে ঢাবি কেন্দ্রীয় মসজিদের পূর্ব গেইট থেকে জবির প্রশ্ন জালিয়াতির চেষ্টাকালে ভর্তিচ্ছু এক ছাত্রীসহ দুই জনকে আটক করা হয়। আটককৃত দুইজন হলেন- জালিয়াত চক্রের সদস্য ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মানিক শেখ ও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী উম্মে কুলসুম।
চলতি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে এ পর্যন্ত ১৯ জনকে আটক করা হয়েছে। তার মধ্যে দুই জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাদ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে। আর বাকিদের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা করা হয়েছে। তবে বরাবরের মতোই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে জালিয়াত চক্রের মূল হোতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক শুক্রবার রাতে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজকের বিষয়টি থেকে বুঝা যায় যে জালিয়াত চক্রগুলোও জালিয়াতিতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। হয়তবা এমন কাজ তারা আরও করার চেষ্টা করেছে। তবে আমি মনে করি যারাই এমন অসাধু কাজ করতে চাইবে, তারাই ধরা পড়বে। তারই ধারাবাহিকতায় আজও একজনকে আটক করা হয়েছে। তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দুই বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের অভিযানও অব্যহত রাখছি। যার করণে হলরুমেও চেক করা হচ্ছে। তবে আগামী পরীক্ষাটিও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে আমরা আমাদের সকল তৎপরতা অব্যহত রাখবো। তাছাড়া আজকের (ক-ইউনিট) মতো আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীও সমানভাবে কাজ করবে।’
এমএইচ/এসকেডি/আরএস/এমএস