করোনা পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিবেশবিদদের ভাবনা
মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে থমকে গেছে গোটা বিশ্ব। প্রায় অচল সব দেশের অর্থনীতির চাকা, চিকিৎসাবিজ্ঞান চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে, প্রতিষেধক প্রত্যাশায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন পৃথিবীর তাবৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানরা। প্রাণভয়ে গৃহবন্দি কোটি কোটি মানুষ। এ যেন গোটা মানবজাতির জন্য চরম অভিশাপ!
সারাক্ষণ ক্ষমতা, প্রযুক্তি আর আধুনিক সব মরণাস্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতায় মত্ত দেশগুলো এখন মন দিয়েছে গবেষণা খাতে। প্রকৃতির দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে আছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো। কখন আর কীভাবে হবে এই সমস্যার অবসান? অন্যদিকে, করোনা প্রকৃতির জন্য যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। করোনার কারণে মানুষের সব তাণ্ডব, ধ্বংসযজ্ঞ আর সৃষ্ট দূষণের হাত থেকে কিছুটা যেন পরিত্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি। আবারও যেন মেলে ধরতে শুরু করেছে তার মাধুর্য। করোনার এমন পরিস্থিতি-কে কীভাবে দেখছেন ভবিষ্যৎ পরিবেশবিদরা?
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (ইএসটি) বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন সজীবুর রহমান।
পিয়াস বিশ্বাস (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
সমগ্র পৃথিবীর পলিসিমেকারদের কাছে কোভিড-১৯ প্যানডেমিক একটা বড় শিক্ষা। করোনা আমাদের বুঝিয়েছে, পৃথিবীর বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো কূটনীতির ভিত্তিতে না হয়ে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। ক্ষমতাধর দেশগুলো যুদ্ধ , বিনোদন বা শুধুমাত্র লোক দেখানো খাতে যে অর্থব্যয় করে, গবেষণা খাতে তার ভগ্নাংশও ব্যয় হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবাহিনী বা সবচেয়ে দামি সুপার কম্পিউটারও ১০ ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র ভাইরাসের সামনে এখন অসহায়। করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, অনুজীব বিজ্ঞান, জিন প্রযুক্তি গবেষণায় আগের চেয়ে অনেক গুরুত্ব দেয়া হবে বলে আমি আশাবাদী। যাতে পরবর্তী প্যানডেমিকের আগে আমরা শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।
নাজনীন সুলতানা (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উৎপত্তি বন্যপ্রাণীর দেহে। মানুষ বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে সংক্রমিত হয় এরপর তা খুব দ্রুতই রূপ নেয় বৈশ্বিক মহামারিতে। আরও অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো এর পেছনেও বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃতির প্রতিশোধপরায়ণতাকে। পৃথিবীতে মানব প্রজাতির সংখ্যাবৃদ্ধি এবং তাদের তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। ক্রমাগত বাসস্থান ধ্বংসের ফলে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের সংস্পর্শ বাড়ছে, আর এসব বন্যপ্রাণীই বহন করে নিয়ে আসছে ভয়ঙ্কর সব অভূতপূর্ব জীবাণু। বরফ গলে মেরু অঞ্চলে হিমায়িত জীবাণুরাও বেরিয়ে আসছে। এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বিশ্বনেতাদের চাপ দিয়ে আসলেও তারা খুব একটা গুরুত্ব দেননি কারণ নীতিনির্ধারকদের কখনও জলবায়ু পরিবর্তনের খারাপ প্রভাবের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু করোনা এসে তাদেরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন অনেক রাষ্ট্রনেতাই বলছেন, নতুন পৃথিবীর কথা। সেই নতুন পৃথিবীতে নিশ্চয়ই প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। মানুষ এবার অন্তত নিজে বাঁচার জন্য হলেও পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করবে।
আলীনুর রহমান রানা (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানের চমকপ্রদ একেকটি বিস্ময় দেখে আমাদের মধ্যে যাদের চোখেমুখে ভেলকি লেগেছিল, আমাদের যারা ভেবেছিলেন আবিষ্কারের যাবতীয় সংস্করণ ইতোমধ্যে সাধিত হয়ে গেছে; করোনাকালীন এই ক্রান্তিলগ্নে এসেও তারা কি এখনও সেই একই ভাবনা ভাবছেন? আজ কোথায় গেল মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতার আর প্রযুক্তির বাহাদুরি? এত ক্ষমতাধর অত্যাধুনিক মানব সভ্যতা এক ক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে অসহায়, আত্মসমর্পণ করে এখন পর্যন্ত প্রায় চার লাখ নিরীহ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। অত্যাধুনিক সভ্যতার মানুষ যারা গোটা পৃথিবীকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখেন তাদের আজ সামান্য একটা ভাইরাসের কাছে নাজেহাল হতে হচ্ছে। তবে কি এই অত্যাধুনিক সভ্যতা ভুল পথে অগ্রসর হয়েছে এতদিন?
আসলে বিরাজমান সভ্যতার বিরুদ্ধে এই ক্ষোভগুলো গড়ে ওঠা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক। বিনোদন, অস্ত্র-গোলাবারুদ আর ক্ষমতার বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে যত টাকা বিনিয়োগ করা হয় তার সিকিভাগও হয়তো শিক্ষা ও গবেষণা খাতে ব্যয় করা হয় না। কারণ, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বিনিয়োগের সঙ্গে ক্ষমতায় টিকে থাকার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
বিশ্বরাজনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মোটামুটি সব দেশ ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের মধ্যেই একটা সামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। সেটা হলো, সব রাজনৈতিক দলের অন্যতম ও একমাত্র লক্ষ্য থাকে ক্ষমতা দখল করা। যাদের নীতিগত আদর্শের সঙ্গে শিক্ষা-গবেষণার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের সঙ্গে যেটার সম্পর্ক থাকে তা হলো পরমতসহিষ্ণুতা, চাটুকারিতা, দালালি ও লেজুড়বৃত্তির। আর ঘুরেফিরে তারাই বারংবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সরকার গঠন করে।
এভাবে পরিচালিত রাজনীতির দুষ্টচক্রের কাছে আমরা পরিবেশবাদীরা কতটুকু আশা করতে পারি? কীভাবে তাদের কাছে আমরা একটা সুন্দর পৃথিবীর রূপরেখা কল্পনা করতে পারি? বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করে যাওয়া এসব ঘৃণ্য আচরণ দূর করতে হলে সবার আগে ব্যক্তিকে সভ্য হতে হবে। তারপর হয়তো ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে একটা শান্তিপূর্ণ সভ্য সভ্যতা। সেই সুদিনের প্রতীক্ষা করে যাবে প্রত্যেক পরিবেশবাদী!
ফারজানা লিজা (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
বর্তমানে আতঙ্কের আরেক নাম করোনাভাইরাস। বাংলাদেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি দিনদিন খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। যেকোনো কিছু থেকে প্রতিকার পেতে হলে প্রথমে তার সমাধান সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। এই মুহূর্তে একমাত্র সচেতনতাই পারে করোনাভাইরাসের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে। করোনাভাইরাসের কারণে যখন পুরো পৃথিবী স্তব্ধ তখন প্রকৃতি যেন ফিরে পেল তার নিজস্ব রূপ। কঠোর লকডাউনের কারণে পরিবেশ দূষণের হার কমতে শুরু করেছে। পৃথিবীর বুকে আমাদের টিকে থাকতে হলে প্রথমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই করোনা পরিস্থিতি তা যেন আমাদের হাড়ে হাড়ে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ কমাতে হলে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে জনসচেতনতার অভাবে এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলার কারণে সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। সংক্রমণ কমে এলেও এটা মানুষের শরীরে থেকে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত, ব্যক্তিজীবনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের এবং পরিবারের লোকদের সুস্থ রাখতে পারব।
মুহাইমিনুল ইসলাম (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
আমাদের প্রজন্ম বর্তমানে একটা বৈশ্বিক সঙ্কট অতিবাহিত করছে। সারাবিশ্বের সবরকম কার্যক্রম লকডাউনে যখন প্রায় স্থবির, তখন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের চোখে পৃথিবীর চিত্র ধরা পড়ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। লকডাউনে বায়ুদূষণ কমছে হু হু করে, দিনেদিনে ওজনস্তরও তার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। পানিতে দূষণের মাত্রা কমেছে আগের তুলনায় ঢের। এতে লাভটা আসলে কার, এ থেকে আমাদের কী শিক্ষণীয় আছে? আদৌ আমাদের শিক্ষা হবে কি?
এটা বলা যায়, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তাপ্রদত্ত একটা সুযোগ। আগের চেয়ে কম বায়ু ও পানিদূষণ করেও আমাদের সব চাহিদা পূরণ হয়ে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের বোতল আগে সারাদিনে গড়ে যে হারে পরিবেশে উন্মুক্ত হতো এখন তার তুলনায় অনেক কম হচ্ছে। নদী আর সমুদ্র উপকূলে এখন আর প্লাস্টিক বা পলিথিন ফেলার কেউ নেই। ফলাফলটা কম-বেশি সবারই জানা। তাহলে এই অভ্যাস আর নিয়মগুলো কি এই লকডাউন থেকেই আমরা ধরে রাখতে পারি না? মানসিকতা পরিবর্তনের এটা একটা মোক্ষম সুযোগ। বলা যেতে পারে, এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকলে বাঁচবে আগামী প্রজন্ম, সঙ্গে দূষণমুক্ত থাকবে পরিবেশ। আমাদের সামান্য সচেতনতা পরিবেশের ওপর কতখানি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা একটু চোখ ডলা দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। তাই আজ আপনার-আমার-প্রশাসনের নৈতিক ও মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানের এই অভিশপ্ত পরিস্থিতি ভবিষ্যত পরিবেশের জন্য হতে পারে আশীর্বাদস্বরূপ।
স্নিগ্ধা ঘোষ (শিক্ষার্থী)
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ, যবিপ্রবি
প্রকৃতি আজ আগের চেয়ে অনেকটা সবুজ ও সতেজ। আগে কেন এতটা প্রাণোচ্ছল ছিল না! করোনা পরিস্থিতির বদৌলতে চলমান এই বিশ্বব্যাপী লকডাউনে পরিবেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরের ওজনস্তর পুনরায় আগের মতো সুস্থ অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে বায়ুদূষণ কমে আসার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মতো বৃহৎ সমস্যার সমাধান সহজতর হয়েছে, কমেছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গমন। সমুদ্রসীমাগুলোতে কমে এসেছে জাহাজ আর জলযানের আনাগোনা, বেড়েছে মাছ ও সামুদ্রিক পাখিদের সমাগম; দেখা মিলছে অন্যসব জীবের অবাধ বিচরণ। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে।
মানবজাতি আজ বিপর্যস্ত কিন্তু প্রকৃতি আজ সুস্থ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তাহলে প্রকৃতির এতদিনের অসুস্থতার জন্য দায়ী আমরা। আমরা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, ঋণি; সেই প্রকৃতির কাছে আমরা অসহায়ও। আজ এই খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার পর প্রকৃতির প্রাণোবন্ততা ধরে রাখার জন্য আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করা এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার। তা না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিছুই নির্ভেজাল অবশিষ্ট পাবে না।
সজীবুর রহমান, যবিপ্রবি/এমএআর/এমএস