যেমন চলছে ঢাবির হলগুলো (পর্ব-১)


প্রকাশিত: ০৪:৩৬ এএম, ০৭ অক্টোবর ২০১৫

প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও জাতীয়ভাবে অবদানের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান প্রথম স্থানেই ধরে রেখেছে। দেশের বহু জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদের জন্ম হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এদের মধ্যে অনেকেই থেকেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। হলগুলোর রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস। সময়ের পরিক্রমায় ফিকে যাচ্ছে হলগুলোর ঐতিহ্য। হলগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে জাগো নিউজের প্রথম পর্বে আজ থাকছে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন হলগুলোর মধ্যে অন্যতম আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামে নির্মিত শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ১৯৫৭ সালে কবি আল্লামা ইকবালের নামে নির্মিত এ হলটির নাম পরিবর্তন করা হয় ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর। ৭১`র মহান মুক্তিযুদ্ধে এ হলেই প্রথম আক্রমণ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটির নমুনাও প্রথম অংকিত হয়েছিল এই হলে। এ হলের শিক্ষার্থীদের রয়েছে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি। তবে ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এই হলটি বর্তমানে বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধারণ ক্ষমতার বেশি ছাত্রের অবস্থান, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, নোংরা পরিবেশ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ হলটি। শিক্ষার্থীরা বলছে, ‘হল প্রশাসনের অনিহার কারণে এগুলোর কোন ধরনের সুরাহা হয় না।’ অন্যদিকে হল প্রশাসন বলছে ‘কিছু সমস্যা রয়েছে, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে।’

খেলাধুলায় ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবাসহ সামাজিক সংগঠন বাঁধন, ডিবেট এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের রয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিও।

হলে ধারণ ক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থীর অবস্থান
গত ২৮ আগস্ট ২০১৫ পর্যন্ত হল রেকর্ড অনুযায়ী বর্তমানে এ হলে আবাসিক, দ্বৈতাবাসিক এবং অনাবাসিক মিলিয়ে সর্বমোট ২ হাজার ৩৮০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যেখানে আবাসিক ৭২৫ জন, দ্বৈতাবাসিক ৬০০ জন এবং অনাবাসিক ১ হাজার ৫৫ জন। হলের মূল ভবনের ১৯৬টি রুম, বর্ধিত ভবনের ৫৪টি রুম এবং টিনশেডের ২৪টি রুমে থাকছে এসব শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এ হলে রয়েছে অবৈধদের ধাপট। অভিযোগ আছে- ঢাকা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ নেতাদের ছত্র-ছায়ায় অবস্থান করছে হলের বিভিন্ন রুমে।

এছাড়া কয়েকটি রুম বহিরাগতদের হিসেবেই গণ্য করা হয়। অন্যদিকে বেশ কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে। তারপরও দখলে রয়েছে নিজেদের সিটগুলো। ক্ষেত্র বিশেষে এলাকাসহ নিজের ছোট ভাইকেও রাখার নজির রয়েছে হলটিতে।

অন্যদিকে বৈধ শিক্ষার্থীরা অব্যবস্থাপনার মধ্যে একরুমে ৮ থেকে ১০ জন এবং গণরুমে ২৫ থেকে ৩০ জন করে থাকছে। যদিও এসব রুমে ৪ জন করে থাকার নিয়ম। শিক্ষার্থীরা বলছে, ‘হল প্রশাসনের আগ্রহের অভাবে এমনটা হচ্ছে।’

নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন
ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর থাকলেও সবচেয়ে নিম্ন মানের খাবার পরিবেশনের জন্য এ হলের দুর্নাম রয়েছে ক্যাম্পাস জুড়ে। অভিযোগ রয়েছে- অন্যান্য হলগুলোর চেয়ে এ হলে সবচেয়ে নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন করা হয়। হল প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব ও ছাত্রলীগ নেতাদের ফাউ খাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে। হলের তিনটি ক্যান্টিনের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খাবার পরিবেশন করা হয় বর্ধিত ভবনের ক্যান্টিনে। তারপর ধারাবাহিকভাবে রয়েছে- মূল ভবনের ক্যান্টিন ও টিনশেডের ক্যান্টিন।

ক্যান্টিন মালিকরা বলছেন, ‘একজনের কাছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বকেয়া ও ফাউ খাওয়ার রীতি বন্ধ না করলে আমরা কিভাবে খাবারের মান ভালো করবো? যদি সবাই ঠিকমতো টাকা পেইড করে তাহলে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। আমরাও ভালো খাওয়াতে পারি।’

নিম্ন মানের খাবার পরিবেশন বিষয়ে হল প্রধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু মু দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, স্বল্প টাকায় এখানে অনেক ভালো খাবারই পরিবেশন করা হয়। বর্তমান বাজারে দ্রব্য মূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে এর চেয়ে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা কঠিন।

তিনি আরো বলেন, আমি মাঝে মাঝে ক্যান্টিনে খেয়ে থাকি খাবারের মান নির্ণয়ের জন্য। যেখানে ক্যান্টিনগুলোকে আগে থেকে কোনো ধরণের ইঙ্গিত দেয়া হয় না। তখন আমার মনে হয় স্বল্প মূল্যে এখানে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয় ভালো খাবার পরিবেশন করার। তবে বর্ধিত ভবনের খাবারের মান একটু খারাপ বলে স্বীকার করেন তিনি।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আরেকটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে শিক্ষার্থীদের বসবাস। হলের বর্ধিত ভবনটি রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। দেখা যায়, এ ভবনের বেশকিছু রুমের পলেস্তরা খসে পড়েছে। কোনো কোনো জায়গায় দেয়াল ভেঙে রড বের হয়ে আসছে। যার দরুণ আতংকে দিনাতিপাত করছেন এ ভবনের শিক্ষার্থীরা।

গত ১ এপ্রিল মাস্টার’দা সূর্যসেন হলের কার্নিশ ভেঙে দুই জন আহত হলে চারটি হলের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সংস্কারের তড়িগড়ি কাজ শুরু হলেও এখন এ বিষয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তবে খুব শিগগিরই এ ভবনের সংস্কার না করা হলেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশংকা করছে শিক্ষার্থীরা।

ভবন সংস্করণের বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসাইন বলেন, ‘ভবনটি সংস্কারের কাজ চলছে। আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।’

দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা
সামান্য বৃষ্টি হলেই হলের ড্রেনগুলোতে পানি জমে যায়। জমে যাওয়া পানি সরতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। নিয়মিত ড্রেন পরিষ্কার করা হয় না বলেই এমন হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। সামান্য বৃষ্টিতে বর্ধিত ভবন এলাকা ও টিনশেড এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।

রাজনীতি
গত ১১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কাউন্সিলের পর ঈদের পূর্ববর্তী সময়ে হলের রাজনীতির পরিবেশ কিছুটা খারপ থাকলেও বর্তমানে অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে চলছে হল রাজনীতি। ছাত্রলীগের পদ প্রত্যাশী নেতারা এখন সময় কাটাচ্ছেন উপর মহলের সঙ্গে লবিং-তদবিরে। ওই সময় হলে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় নতুনভাবে তৈরি হওয়া ৬টি গ্রুপের মধ্যে। বর্তমানে হলে পদ প্রত্যাশী ৬ জন নেতার ৬টি গ্রুপ রয়েছে। সামনে হল কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে লড়াতে জোর লবিং-তদবির চালাচ্ছেন তারা।

খেলাধুলা
ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, টেবিল টেনিসসহ খেলাধুলার সকল অঙ্গনে এ হলের শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। সর্বশেষ আন্তঃহল ফুটবল প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ, ভলিবলে চ্যাম্পিয়নসহ ক্রিকেট, টেবিল টেনিস ও সাঁতারেও রয়েছে এ হলের শিক্ষার্থীদের ভালো খেলার নজির।

সাংস্কৃতিক অঙ্গন
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল সংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ২ মার্চ জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু অনুষ্ঠান এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে।

ডিবেটিং ক্লাব
বিতর্কেও রয়েছে এ হলের শিক্ষার্থীদের দাপট। টেলিভিশনসহ বিভিন্ন জাতীয় বির্তক প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্বের নজির রয়েছে হলটির। সর্বশেষ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সঙ্গে বিটিভিতে প্রদর্শিত বির্তক প্রতিযোগিতায় রানার্স আপ হয়েছে।

হলের ২০১৬ নম্বর কক্ষের দ্বৈতাবাসিক ছাত্র মো. মাসুদুল আলম সুমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদিও খেলাধুলাসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের হলটি অনেক এগিয়ে আছে তথাপি ঝুঁকিপূর্ণ বর্ধিত ভবনের সংস্কার, হলের তিন নম্বর গেইট খুলে দেয়া, মোবাইলে রিচার্জের দোকানের ব্যবস্থাসহ ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে কাজ করা দরকার।’

এমএইচ/আরএস/এআরএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।