ভারপ্রাপ্তের ভারে ভারাক্রান্ত ঢাবি
কোনো ভাবেই ভারপ্রাপ্তের ভার থেকে মুক্ত হতে পারছেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির প্রশাসনিক ১২টি পদই চলছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে। দীর্ঘদিন যাবৎ ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলায় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে ওইসব বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে প্রক্টর, জন-সংযোগ কর্মকর্তা, হিসাব পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ সবই চলছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন না এসব শাখার কর্মকর্তাদের পদগুলো স্থায়ী করা হবে, ততদিন ওই সব শাখার কার্যক্রম চলবে ধীর গতিতে।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়- দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ বিদ্যাপীঠের প্রথম সারির প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ১২টি পদই আক্রান্ত রয়েছে ভারপ্রাপ্তদের ভারে। কিন্তু এসব শাখাকে ভারমুক্ত করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগও দেখা যাচ্ছেনা ।
ঢাবি সূত্রে জানা যায়, অনেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মেয়াদ শেষ হওয়া সত্ত্বেও পদটিতে কর্মরত রয়েছেন তারা। ওইসব কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ীকরণে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে না। কারো কারো আবার চুক্তি ভিত্তিক মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। আবার এদের মধ্যে কয়েকজন নিয়মিত কর্মস্থলেই আসেন না। তাই এসব বিভাগের কর্যক্রম চলছে ধীর গতিতে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটা কৌশল। কখনো কখনো ভারপ্রাপ্ত আবার কখনো কখনো স্থায়ী হিসেবে কাজ করানো হয়। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে দুই ধরনের বক্তব্য।
একটি গ্রুপ মনে করে তিনি যোগ্য না হয়েও এ পদে নিয়োজিত রয়েছেন এর থেকে বেশি আর কি পাওয়া যেতে পরে। তবে অন্য একটি গ্রুপের মধ্যে হতাশা বিরাজ করেছে। আবার এই হতাশা আর স্থায়ী হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে কেউ কেউ চাকরির মেয়াদও শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নিতে চান না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন সৈয়দ রেজাউর রহমান। তিনি ২০০৭ সালের ৩০ জুন থেকে এ পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এখনো কর্তপক্ষের কোনো উদ্যোগ নেই তাকে স্থায়ী করার। এভাবে চাকরির মেয়াদও শেষ হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিভাগের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসা এ প্রশাসনিক কর্মকর্তার।
দেখা যায় ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন ১৯ জন কর্মকর্তা। যার মধ্যে ১২ জনই কর্মরত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে।
শিক্ষার্থীদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ দফতর ‘প্রক্টর অফিস’। এ বিভাগটিও চলছে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে। ৪ অক্টোবর ২০১১ সাল থেকে এ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী। গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটি ভারপ্রাপ্ত হওয়ায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিপদে তারা প্রক্টরকে কাছে পান না। তাছাড়া প্রক্টর চলছেন ছাত্রলীগকে নিয়ে। বাম সংগঠনগুলো ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন থাকলেও ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেন না ছাত্রদল ঘেঁষা নেতারা।
লোকমুখে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে ‘ছাত্রলীগ ধরে, আর প্রক্টরের কাছে হস্তান্তর করে। প্রক্টর যাচাই বাচাই না করেই শাহবাগ থানা পুলিশে হস্তান্তর করেন, এরপর তদন্ত।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ‘হিসাব বিভাগ’। ২০০৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে এ বিভাগে নিয়োগ পান মো. আশরাফ উদ্দিন। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গত ৩১ জুন আবার নতুন করে এ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে এ কর্মকর্তাকে। ৬ মাসের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি।
কর্তৃপক্ষ বলছে, যোগ্য লোকের অভাবের কারণে এ বিভাগটি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে চলছে। যদিও অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৬৬ সাল থেকে এ বিভাগে কর্মরত ১৩ জন হিসাব পরিচালকের মধ্যে ৭ জনই বিভিন্ন সময়ে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
ড. নূর-ই-ইসলাম (সেলু বাসিত) জন-সংযোগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের গুরুত্বপূর্ণ এ পদটিতে তিনি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ করছেন ২০১৪ সালের ২৯ জুন থেকে। তাকেও স্থায়ী করার কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। যার কারণে এ বিভাগের কাজেও রয়েছে ঢিলেমি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে অধ্যাপক ড. এস এম জাবেদ আহমদ ভারপ্রাপ্ত গ্রান্থগারিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। এ বিভাগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রান্থগারিক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) শাখা। এখানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন সৈয়দা ফরিদা পারভীন।
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এর পরিচালক আলমগীর হোসাইনও রয়েছেন ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন তিনি ৬ মাসের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান।
‘অ্যাস্টেট অফিস’এর ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার সুপ্রিয়া দাস নিয়োজিত রয়েছেন ২০১১ সালের ২ জুলাই থেকে। ভারপ্রাপ্ত থেকে স্থায়ী হওয়ার আশায় গুরুত্বের সাথে অফিসের দেখভাল করলেও মিলছে না স্থায়িত্ব।
পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন জীবন কুমার মিশ্র। তিনি ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এ বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাকেও স্থায়ী করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মো. মফিজুল ইসলাম । এছাড়া ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক শাহীন ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় মুদ্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের (ম্যানেজার) দায়িত্বে রয়েছেন এস এম বিপাশ আনোয়ার। তিনি ৬ জুন ২০০৯ সাল থেকে এ বিভাগে নিয়োজিত রয়েছেন।
অধ্যাপক ড. এ টি এম নরুর রহমান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এ বিভাগের পাণ্ডুলিপি নির্বাচন, সম্পাদনা ও অনুবাদ শাখার সচিবও ভারপ্রাপ্ত। অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ সচিব হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।
গুরুত্বপূর্ণ ১২টি পদে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা প্রশাসনেরই একটা পদ্ধতি। কখনো কখনো ভারপ্রাপ্ত আবার কখনো স্থায়ী দিয়ে চলে। এটা প্রশাসনিক বিধি বিধানের মধ্যেই রেখে করা হয়। তবে আমাদের চিন্তা আছে এগুলোকে স্থায়ী করার ব্যাপারে।’
এমএইচ/এসকেডি/এসএইচএস/এমএস