নেপথ্যে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব, হাতিয়ার ছাত্রলীগ!

আবদুল্লাহ রাকীব
আবদুল্লাহ রাকীব আবদুল্লাহ রাকীব , বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ০৩ এপ্রিল ২০১৯
বিভাগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ পান এমদাদুল হক

শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নেই বিভোর ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এমদাদুল হক। আর সেই লক্ষ্যেই গড়ে তোলেন নিজেকে। বিভাগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক’ পান। কিন্তু গত ২৭ মার্চ চবিতে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিতে গিয়ে ‘অপহৃত’ ও লাঞ্ছনার শিকার হন। ভেঙে যায় শিক্ষকতার স্বপ্ন।

মূলত গবেষণা ও থিসিসের কাজে বিভাগের এক শিক্ষকের সঙ্গে এমদাদুলের ভালো সম্পর্ক এবং ওই শিক্ষকের সঙ্গে অন্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে কপাল পোড়ে তার। আর পুরো ঘটনাকে সরলীকরণ করতে দেয়া হয় ‘শিবির’ আখ্যা। যেটিকে পুঁজি করে মেধাবী এমদাদকে ঠেকাতে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া হয় ছাত্রলীগকে।

গত কয়েকদিনে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মারফতে জানা গেছে নেপথ্যের এ কারণ।

শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে বিএসসি (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন এমদাদুল হক। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত বিএসসি (সম্মান) পরীক্ষায় সম্মিলিত ফলাফলে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ৩.৮৮ পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। যা ছিল প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সর্বোচ্চ সিজিপিএর পাশাপাশি জীববিজ্ঞান অনুষদের ৯টি বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ সিজিপিএ। ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধীনে এমএস (ফিশারিজ অ্যান্ড লিমনোলজি) কোর্সে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ৩.৯৬ পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন তিনি।

এদিকে ২০১৩ সালে তিনি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়ার অধীনে থিসিস করার অনুমতি পান। যদিও এর আগে থেকেই গবেষণা ও বিভিন্ন প্রজেক্টে এ শিক্ষকের সহযোগী হিসেবে এমদাদুল কাজ করতেন। ওই শিক্ষকের অত্যন্ত আস্থাভাজনও ছিলেন এমদাদ। এমদাদুলের সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এসব কথা। এমদাদুল নিজেও তা জাগো নিউজের কাছে স্বীকার করেন।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক জার্নালে এমদাদুলের তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। দুইটি পেপার প্রকাশিত হয় পোল্যান্ডের নামকরা পোলিশ একাডেমির জার্নাল অ্যানালস অব প্যারাসিটোলজি ও জার্নাল অব স্প্যাসিস এবং অন্যটি ইন্ডিয়া থেকে।

বিভাগের একজন শিক্ষকের সঙ্গে কোনো শিক্ষার্থীর ভালো সম্পর্ক থাকতেই পারে। তাহলে এমদাদের ওপর কেন বিরাগভাজন হবেন অন্য শিক্ষকরা? এ প্রশ্নের কারণ উদ্ঘাটন করতে জাগো নিউজ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান ১২ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। এতে জানা গেছে, প্রাণিবিদ্যা বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। ফলে দুটি ধারায় বিভক্ত বিভাগের শিক্ষকরা। এর মধ্যে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক না হয়েও হালদা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ও চবি হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া গবেষণাসহ নানা কাজে সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন বলে অভিযোগ অন্য পক্ষের। এছাড়া একাডেমিক নানা বিষয়কে কেন্দ্র করেও তার সঙ্গে অন্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমদাদুলের শিক্ষক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। মৌখিক পরীক্ষার জন্য চিঠি পাওয়া ৬৪ জনের মধ্যেও ফলাফল ও গবেষণা কর্মে এমদাদুল এগিয়ে ছিলেন। এমদাদুল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে, বিভাগে ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়ার প্রভাব আরও বিস্তৃত হবে। ফলে মঞ্জুরুল কিবরীয়ার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এমদাদুলকে নিয়োগ পরীক্ষা থেকে দূরে রাখার পরিকল্পনা করা হয়।

ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত পুলিশকেও শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা জানিয়েছিলেন এমদাদুল। জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন ওই দিন ফাঁড়িতে দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপ-পরিদর্শক পরেশ চন্দ্র সিকদার।

ভোক্তভুগী এমদাদুল হক পুরো ঘটনার পেছনে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীদের মধ্যে ছয় জনকে সন্দেহ করেন। তবে কোনো শিক্ষকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু না বললেও জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে সন্দেহভাজন ছয় প্রার্থীর থিসিসের সুপারভাইজারদের বিষয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন সেন্ট্রাল ফিল্ডে আমাকে নিয়ে গেলে তারা এক শিক্ষকের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপও করে। তবে আমি আদালতে মামলা করেছি। তাই এ মুহূর্তে আমার কোনো শিক্ষকের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে চাই না।

Emdad

অপরদিকে বিভাগে শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে স্বীকার করে অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জাগো নিউজকে বলেন, গবেষণায় প্রতিযোগিতা থাকবে। আমার সমালোচকও থাকবে। কিন্তু এমন প্রতিযোগিতা হিংসাত্মক পর্যায়ে যাবে তা আমাদের কোনো শিক্ষকের কাছে অপ্রত্যাশিত। এ ঘটনায় যারা অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী উভয়ই আমার ছাত্র। তারা কখনো আমাদের সামনে চোখ তুলে তাকায়নি। নিশ্চয়ই এ ঘটনার পেছনে কেউ তাদের ভুল তথ্য দিয়ে উসকানি দিয়েছে অথবা অন্যভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি প্রশাসনকে আহ্বান করছি, ছাত্রদের নয়, যারা এ ঘটনার পেছনে ইন্ধন দিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে আনা হোক।

যেভাবে যুক্ত করা হয় ছাত্রলীগকে

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রভাষক পদে শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার বিষয়ে এক সপ্তাহ আগেও কিছু জানতেন না অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযুক্তদের মধ্যে ছাত্রলীগের একজন জাগো নিউজকে জানান, বিভাগের এক শিক্ষক মৌখিক পরীক্ষার বিষয়টি তাদের জানান। এ বিষয়ে আর কী করা যায় সে ব্যাপারেও তাদের কাছে জানতে চান এবং বিভাগে আসতে বলেন।

আর ওই ছাত্রলীগ নেতার বক্তব্যের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এতে বিভাগ ও বিভাগের বাইরে কয়েকজন শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভাগের ২টি প্রভাষক পদের বিপরীতে মৌখিক পরীক্ষায় ৬৪ জন চাকরিপ্রার্থী ছিলেন। এদের মধ্যে ওই শিক্ষকদের পছন্দের প্রার্থীও ছিল। যদিও ফলাফল ও গবেষণা কাজে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পাওয়া এমদাদুল হক।

এই ঘটনায় ৭ জনকে অভিযুক্ত করে গত ৩১ মার্চ চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা করেন এমদাদুল হক। অভিযুক্তরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হিসেবে পরিচিত। অভিযুক্তদের মধ্যে একজন ব্যতীত বাকি ছয় জনই প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। আগে থেকেই অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়ার ওপর ক্ষোভ ছিল তাদের। এর সঙ্গে যোগ হয় শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ- দুটোই প্রভাব ফেলে এমদাদুলের ওপর।

সত্যতা মেলেনি শিবির সম্পৃক্ততার

অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছে এমদাদুল চিহ্ণিত শিবির। তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসম্পাদক শরীফ উদ্দীন বলেন, ২০১২ সালের ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের সময় শিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমদাদুল। অনেকেই তা দেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই আমাদের বলেছেন। তাই মৌখিক পরীক্ষা দিতে এলে তাকে মারধর করে পুলিশের কাছে তুলে দেয়া হয়।

তবে তাদের এই দাবির সত্যতা মেলেনি। হাটহাজারী মডেল থানায় ঘটনার দিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত যাচাই বাছাই করেও শিবির সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাও এমদাদুলের শিবির সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি।

হাটহাজারী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, আমরা শিবিরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কিছুই পাইনি। থানায় দুই এক ঘণ্টা রাখার পর আমরা তাকে ছেড়ে দিয়েছি।

বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালীন বা ২৭ মার্চের আগেও এমদাদুল কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে জানান অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তাকে যারা এখন শিবির আখ্যা দিচ্ছে তাদের সঙ্গে এমদাদুলের পূর্বে কোনো দ্বন্দ্বও দেখেননি। বরং তাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষার দিন ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা।

সার্বিক এসব বিষয়ে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, নতুন করে মৌখিক পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ নেয়। তবে আবার বিজ্ঞপ্তি হলে সে আবেদন করতে পারবে। তখন যদি সে নিরাপত্তা চায়, আমরা নিরাপত্তা দেব। আর সেদিন তার নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের যদি বলতো তাহলে একটা ভিন্ন চিত্র ছিল।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ ঘটনায় আলাদা কোনো তদন্ত করার সুযোগ নেই। যেহেতু বর্তমানে আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।