ছাত্রলীগের দখলে হল, জিম্মি প্রশাসন

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ০৯:২৪ এএম, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ছাত্রদের আবাসিক হলের প্রায় ৬৬ শতাংশ ছাত্রই থাকছেন অবৈধভাবে। ছাত্রলীগ পরিচয়ে হলে অবস্থান করায় হল প্রশাসনও জিম্মি হয়ে পড়েছেন। তবে ছাত্রলীগের দাবি, হল চালাতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদের দায় ছাত্রলীগের উপর চাপাচ্ছে হল প্রশাসন।

হল সূত্র মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এ হল দুটিতে মোট ৫৯৬টি আসনের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ৩৯৩টি আসন। হল প্রশাসন নামকাওয়াস্তে আসন বরাদ্দ দিলেও ফাঁকা আসন বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আসন বুঝে চাইলে তা ক্ষমতাসীনদের দখলে বলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে দায় এড়াচ্ছে। বৈধ শিক্ষার্থী না থাকায় অর্থসঙ্কটেও পড়েছে হল দুটি। ফলে বঙ্গবন্ধু হলে চার মাস এবং ইলাহী হলে পাঁচ ধরে বন্ধ রয়েছে ডাইনিং কর্মচারীদের বেতন।

হল দুটির প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ৩৫৬টি আসনের মধ্যে বৈধ বাসিন্দা ৪৫ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর শহীদ মুখতার ইলাহী হলের ২৪০টি আসনের মধ্যে বৈধ বাসিন্দা ১৫৮ জন, অর্থাৎ ৬৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। শুধু ফাঁকা আসন নয় এরও দিগুণ শিক্ষার্থী অবৈধভাবে থাকছেন ছাত্র হল দুটিতে। তবে ছাত্রীদের একমাত্র শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের প্রায় শতভাগ বাসিন্দাই বৈধ। যারা নিয়মিত হলের ফি পরিশোধ করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন সূত্র বলছে, ছাত্রদের দুইটি হলই এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। হলে ভর্তি না হয়েও ছাত্রলীগের নেতাদের মাধ্যমে ছাত্ররা অবৈধভাবে হলে উঠছেন।

তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মোন্নাফ আল তুষার কিবরিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রলীগ পরিচয়ে কেউ হলে থাকছে এমন দায় ছাত্রলীগ নেবে না। হল প্রশাসন চাইলে এসব পরিচয়ধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আসন খালি করতে পারে।

হলে অবৈধভাবে অবস্থান করা কমপক্ষে ১৫ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলগুলো ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে হলে উঠেছেন। ছাত্রলীগ পরিচয়ে থাকছেন। ছাত্রলীগের মিছিলে গেলে হলে থাকায় কোনো সমস্যা হয় না তাদের। এভাবেই দুই-তিন বছর ধরে হলে থাকছেন কেউ কেউ। হলের ফি না দিয়েও থাকা যায় তাই তারা আর বৈধ হওয়ার তাগিদও অনুভব করেননি।

হল সূত্র জানায়, হলে আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে গত বছর সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু হল ও ইলাহী হল ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দেয়। শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু হলে ৬৭ জনকে এবং ইলাহী হলে ৩৬ জনকে আসন বরাদ্দ দেয় হল কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলে ১৩ জন এবং ইলাহী হলে ২৬ জন ভর্তি ফি দিয়ে বৈধভাবে হলে ওঠেন।

বাকিদের হলে না ওঠার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, কাগজে-কলমে আসন ফাঁকা থাকলেও সবই অবৈধদের দখলে। যার মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছত্রছায়ায় রয়েছেন। হলের ভর্তি ফি দিয়েও বরাদ্দ হওয়া আসন ফাঁকা পান না বৈধরা। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অহেতুক ঝামেলায় না জড়িয়ে ছাত্রাবাসে থাকতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৯ জানুয়ারি ইলাহী হলে বৈধ ফাঁকা আসনের বিপরীতে হলে উঠতে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত দৈনিক সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আল আমিন হোসাইন এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌম্য সরকার। হল প্রশাসন এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোন্নাফ আল তুষার কিবরিয়াকে জানিয়ে বরাদ্দ পাওয়া ৬০৩ নম্বর কক্ষটিতে উঠতে যান। এ সময় বেরোবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদ উল ইসলাম জয়ের নেতৃত্বে তার সহযোগীরা তাদের পিটিয়ে আহত করেন। পরে এ ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষ মো. ফেরদৌস রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

সরেজমিনে হলে গিয়ে দেখা যায়, গত ২৯ জানুয়ারি এক বিজ্ঞপ্তিতে ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হলে অবস্থানকারী স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হওয়া শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে বঙ্গবন্ধু হল প্রশাসন। তৃতীয়বারের মতো দেয়া এ নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সর্তক করা হয়েছে। হল ছাড়তে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইলাহী হল প্রশাসনও। অথচ তা কেবল নির্দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় দখলমুক্ত হচ্ছে না হলের অবৈধ আসন।

অন্যদিকে হলের বৈধ শিক্ষার্থীরা বলছেন, হলের নিয়মিত ফি পরিশোধ করেও তারা প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বৈধ আসনে অবৈধদের দাপটে অস্থির তারা। তাদের সঙ্গে লিয়াজো করেই হলে থাকতে হচ্ছে তাদের। অথচ হল প্রশাসনকে অভিযোগ করে কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।

তবে চিত্র ভিন্ন ছাত্রীদের একমাত্র আবাসিক হল শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের। হলটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকায় ৩৪০টি আসনের প্রায় সবকটিতে থাকেন বৈধ বাসিন্দারা। ছাত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা শতভাগ ছাত্রীর ভর্তি ফি দিয়ে হলে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

বঙ্গবন্ধু হলের প্রাধ্যক্ষ তাবিউর রহমান প্রধান জাগো নিউজকে বলেন, বারবার অবৈধ ছাত্রদের তাগাদা দিয়ে এবং অনুরোধ করেও তারা হল ছাড়ছেন না। তাই যেকোনো সময় আসন ফাঁকা করতে আইনি ব্যবস্থায় যেতে পারেন বলে জানান তিনি।

ইলাহী হলের প্রাধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক মো. ফেরদৌস রহমান বলেন, অনাবাসিকদের কারণে নতুন করে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের স্বদিচ্ছা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথাযথ পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।

এদিকে ভর্তি ফি না দিয়ে ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলে ওঠা, থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোন্নাফ আল তুষার কিবরিয়া বলেন, ছাত্রলীগের প্রভাবে নয় বরং হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় হলে বৈধ ছাত্র উঠছে না। হলে বৈধ শিক্ষার্থী ওঠাতে ছাত্রলীগ সবসময় সহযোগিতা করে আসছে।

সজীব হোসাইন/এফএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।