খসড়া আচরণবিধিতে যে পরিবর্তন চায় ছাত্র সংগঠনগুলো

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৮ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটি খসড়া যে আচরণবিধি প্রস্তুত করেছে তার বিপরীতে নিজেদের মতামত দিয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো। ইতোমধ্যে নিজ নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনাগুলো পৌঁছে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিটিকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদকে প্রধান করে করা সাত সদস্যের আচরণবিধি প্রণয়ন কমিটি গত শুক্রবার একটি খসড়া আচরণবিধি তৈরি করে ছাত্র সংগঠনগুলোকে পাঠিয়েছিল। ১৪ ধারা বিশিষ্ট আচরণবিধিতে কোনো সংগঠনের আপত্তি থাকলে লিখিতভাবে তা যেন শনিবারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কমিটিকে পৌঁছে দেয়া হয় তার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।

সে অনুযায়ী ছাত্র সংগঠনগুলো ১৪ ধারা বিশিষ্ট খসড়া আচরণবিধি পর্যালোচনা করে নিজেদের মতামত দিয়েছে। সংগঠনগুলোর দেয়া মতামতগুলোর মধ্যে রয়েছে-

ছাত্রলীগের প্রস্তাবনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক পরিবেশ, একাডেমিক কার্যক্রম, ক্লাস-পরীক্ষা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-লাইব্রেরির পরিবেশ ব্যাহত করে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না; ৫ (জ) সংশোধন করে শিক্ষার পরিবেশ ও স্বাভাবিক ক্যাম্পাস জীবনের স্বার্থে মাইকের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। ছাত্র সমাবেশ বা অডিটেরিয়ামের অভ্যন্তরে মাইকের ব্যবহার সীমিত রাখতে হবে; দেয়াল লিখনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন-সাহস-সংগ্রাম প্রতিধ্বনিত হয়। ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যবাহী এ প্রথার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না; মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির স্বার্থে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ও হলগুলোতে নির্বাচনী বিতর্কসভার আয়োজন করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচন একান্তই একাডেমিক-বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র-অধিকার কেন্দ্রীক। নির্বাচনের মিথস্ক্রিয়া ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। বর্তমান ছাত্র নেতা ছাড়া ডাকসু বা হল সংসদের সাবেক নেতরা বা অন্য কাউকেই রাজনৈতিক প্রচারণায় সম্পৃক্ত করা যাবে না। ক্যাম্পাসের রাজনীতি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই পরিচালিত হতে হবে; আচরণবিধি সাপেক্ষে, সাংবাদিকদের কার্যক্রম পরিচালনা করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে; ৫ (খ) সংশোধন করে সভা-সমাবেশ-শোভাযাত্রা করার অনুমতি ৪৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ২৪ ঘণ্টা করতে হবে; কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধির কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে, সংক্ষুব্ধ যে কেউ চিফ রিটার্নিং অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তদন্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার মধ্যে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে; নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় বা অঞ্চলকে ব্যবহার বা অপব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবে না; শিক্ষার্থীদের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্বাচনী ব্যয়সীমা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।

ছাত্রদলের প্রস্তাবনা

তফসিল ঘোষণার পর ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের কোনো প্রকার হয়রানি, মামলা দেয়া এবং গ্রেফতার না করার বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ছাত্রদল। এ ছাড়াও সংগঠনটির পক্ষ থেকে নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা সংক্রান্ত ৪(গ) ধারা সংশোধন করে পরিবেশ পরিষদের সব ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সব নেতাকে নিজ নিজ সংগঠনের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা ও প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠানে সাবেক ডাকসু নেতাদের উপস্থিত থাকার সুযোগ দেয়ার দাবি জানানো হয়। ছাত্রদলের অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যে আছে- ভোট প্রদানের গোপন বুথ ছাড়া ভোটকক্ষ এবং সমগ্র ভোটকেন্দ্র ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনা। নির্বাচনী সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রা সংক্রান্ত ৫(খ) ধারা সংশোধন করে প্রচার-প্রচারণাকে আরও প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার পূর্বে সভা সমাবেশ ও শোভাযাত্রা করার অনুমতি গ্রহণের সময়সীমা শিথিল করা। উস্কানিমূলক বক্তব্য বা বিবৃতি প্রদান এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যাতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে অথবা করলে তাদের সহজেই শনাক্ত করা যায়। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত ১০(ক) ধারায় বলা হয়েছে, রিটার্নিং অফিসাসের ‘অনুমোদিত ব্যক্তি’র সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা করা এবং রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া গণমাধ্যম কর্মীদের অবাধে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ, ছবি তোলা এবং ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচার করার সুযোগ নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়।

ছাত্র ইউনিয়নের প্রস্তাবনা

ছাত্র ইউনিয়ন খসড়া সুপারিশমালার ৪ এর (গ) ধারা সংশোধন করে ডাকসুর সাবেক নেতাদের প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করার সুযোগের প্রস্তাবনা দিয়েছে। ৫ এর (গ) ধারাটিও সংশোধন চায় সংগঠনটি। এর বদলে প্যানেল পরিচিতি সভা প্রশাসনের উদ্যোগে করার সুপারিশ করেছে তারা। এ ছাড়াও ৬ (গ) ধারাটি সংশোধন করে দেয়ালে কোনো প্রচারণা না চালানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে। একইসঙ্গে পূর্ববর্তী দেয়াল লিখন মুছে দেয়া, ভোটকেন্দ্রগুলোকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা এবং গণমাধ্যমকর্মী এবং কোনো প্রার্থী সিসিটিভির ফুটেজ নিতে চাইলে রিটার্নিং কর্মকর্তা তা দিতে বাধ্য থাকার প্রস্তাবও আছে ছাত্র ইউনিয়নের আচরণবিধি সংস্কার প্রস্তাবে।

ছাত্র ফেডারেশনের প্রস্তাবনা

আচরণবিধির ৪ (গ) ধারাটি সংশোধন করে কোনো ব্যক্তির খ্যাতির মানদণ্ড সুনির্দিষ্ট করার দাবি জানিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন। এ ছাড়াও ৫ (গ) ধারাটি সংশোধন করে একজন প্রার্থী বা একটি প্যানেলের পক্ষে প্রতিটি হলে একটির পরিবর্তে তিনটি ও বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তিনটির বদলে ৫টি প্রজেকশন মিটিং করার অনুমতি চেয়েছে সংগঠনটি। পাশাপাশি ভোটগ্রহণ কার্যক্রমে কোনোরূপ বাধা না দিয়ে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে সাংবাদিকদের ছবি তোলা ও ভিডিও করার ব্যবস্থা থাকার সুপারিশ করেছে সংগঠনটি। এ ছাড়াও প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনের ব্যয়সীমা নির্দিষ্ট করা, রঙিন পোস্টার না করা, নির্বাচনী ক্যাম্প না বসানো, আলোকসজ্জা না করা, ভোটার স্লিপ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে দেয়ার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রেখেছে তারা।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রস্তাবনা

‘আচরণবিধির খসড়াটির ৪ নম্বর ধারা’অনুযায়ী প্রস্তাব হলো প্রচারণার সময় রাত ১০টার বদলে রাত ১২টা পর্যন্ত বাড়ানো। খসড়ার ৫ নং ধারার (ক) ও (খ) উপধারা অনুযায়ী প্রস্তাবনা হলো মৌখিকভাবে জানানোর বিষয়টি থাকতে পারে, যাতে দু’টি অনুষ্ঠান একই স্থানে না পড়ে যায়। একই ধারার (ঘ) উপধারার বিপরীতে সংগঠনটির প্রস্তাব হলো- মৌখিকভাবে বলার বিধান থাকাই যুক্তিযুক্ত। কারণ, (ঙ) ও (চ) উপধারায় যা বলা আছে, তারপরও লিখিতভাবে অনুমতির বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের পরিচায়ক। ৬ (ক) উপধারার ক্ষেত্রে তাদের মতামত হচ্ছে পোস্টার ও হ্যান্ডবিল, লিফলেটের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া যেতে পারে। হ্যান্ডবিল ৩৫ হাজার এবং পোস্টার ৫ হাজার কপি হতে পারে। খসড়া আচরণবিধির ৭ নং ধারার (ক) উপধারা মোতাবেক প্রস্তাব হলো- নির্বাচনী আচরণবিধিতে গণচাঁদার বিষয়টি যুক্ত করা। ৮ (ক) উপধারা এবং ৮ নং ধারার পরের উপধারার বিপরীতে প্রস্তাব হলো- সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক গঠনমূলক সমালোচনার বিধি প্রয়োজনীয়। নয়তো যে কোনো কথাকেই ‘কোড’(উদ্ধৃত) করে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করার ফাঁক থেকে যায়। ৫ (চ) উপধারার জন্য প্রস্তাব হলো- ক্লাসরুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতামত বিনিময়ের সুযোগ (ক্লাস ক্যাম্পেইন) যেমন থাকতে হবে, একইসঙ্গে বক্তব্য প্রচারের জন্য করিডোরে মিছিলের মতো প্রচলিত ও সর্বজনস্বীকৃত কার্যক্রমকে ‘নির্বাচনী আচরণবিধি’তে যুক্ত করতে হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রস্তাবনা

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- সব শিক্ষার্থী যাতে নির্বিঘ্নে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করতে পারে; কোনো রাজনৈতিক সংগঠন যাতে ক্যাম্পাসে সবার সহাবস্থানে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি না করতে পারে; সম্প্রতি যারা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্নভাবে হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; ঢাবির বিভিন্ন হলে আবাসিক শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো প্রকারের নির্যাতন বা ভয়ভীতির সম্মুখীন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং সর্বোপরি ডাকসুর নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণার আগেই ক্যাম্পাসে নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা।

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ মার্চ।

এমএইচ/এনডিএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।