রাবি’র ফলিত গণিতের মাস্টার্সের ফল দুই বছরেও প্রকাশ হয়নি


প্রকাশিত: ১০:৪৭ এএম, ১১ জুন ২০১৫

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের মাস্টার্সের (এমএসসি-২০১২) এর পরীক্ষা দুই বছর পার হলেও প্রকাশ হয়নি এর ফলাফল। নম্বরপত্র টেম্পারিং-এর অভিযোগের জেরে বিএনপি ও আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে কারণে এ ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে। এতে ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবনের শেষ স্তরে এসে ভোগান্তিতে পড়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিএনপিপন্থী শিক্ষক প্রফেসর শামসুল আলম সরকার কর্তৃক এক ছাত্রের নম্বরপত্র টেম্পারিং-এর অভিযোগ তোলে বিভাগের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা। পরে তা মীমাংসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের মাধ্যমে বিভাগের একাডেমিক কমিটির সিদ্ধান্তের জন্য মিটিংয়ের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেন।

নির্দেশনা অনুযায়ী বিভাগীয় সভাপতি ২৮/১২/২০১৪ তারিখে একাডেমিক কমিটির সভা আহ্বান করেন। ওই মিটিংয়ে বিভাগের ১০ জন শিক্ষকের ৭ জন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে জমা হওয়া ফল প্রকাশের ব্যাপারে সম্মতি দিলেও বিভাগের বর্তমান সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল হকসহ আওয়ামীপন্থী আরো ২ জন শিক্ষক অসম্মতি জানান।

এমনকি ‘কোন সিদ্ধান্ত ছাড়ায় মিটিং শেষ হয়েছে’ মর্মে বিভাগের সভাপতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে চিঠি দেন। পরে সম্মতি জানানো বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা চিঠি দিয়ে তাদের সম্মতির বিষয়টি নিয়ন্ত্রককে অবগত করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের প্রথম দিকে একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে অধিকাংশ শিক্ষকের সম্মতি থাকায় নিয়ন্ত্রক দপ্তরে জমা থাকা ফল প্রকাশের অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর দু’দিন পরেই আবার অজ্ঞাত কারণে তা স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়।

বিভাগের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিভাগের বর্তমান সভাপতি ও আওয়ামীপন্থী অপর দু’জন শিক্ষক এর আগে শামসুল আলম সরকারের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলতো। কিন্তু অতি সম্প্রতি তাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে দ্বন্দ্ব হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’

এদিকে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, টেম্পারিং-এর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেয়ায় ফল প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ব্যাপক দুর্ভোগে পড়েছেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জয়ন্ত কর্মকার বলেন, ‘আমি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর একটি ব্যাংক থেকে শিক্ষা ঋণ নিয়ে পড়ালেখা করেছি। নিয়ম অনুযায়ী আমাকে চলতি জুন মাস থেকে ঋণ শোধ করতে হবে। কিন্তু মার্স্টাসের সার্টিফিকেট না থাকায় কোথাও চাকরির আবেদনও করতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে আমি ও আমার পরিবার চরম দুরাবস্থায় দিন কাটাচ্ছি।’

আরেক ফলপ্রার্থী শিক্ষার্থী মো. তারেকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছোট দুই ভাইবোন লেখাপড়া করছে। বাবা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। এতদিন তিনি অনেক কষ্টে আমার খরচ বহন করেছেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবো। ভাইবোনদের পড়ালেখাসহ পুরো পরিবারের দেখভাল করবো। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকদের নোংরামিতে আমি ও আমার পরিবার আজ চরম দুর্ভোগে পোহাচ্ছি।’

বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ফলিত গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে নম্বর বাড়িয়ে দেন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শামসুল আলম সরকার। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামীমা সুলতানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গত ০৩/০৯/২০১৪ তারিখে এমএসসি-১২ ব্যাচের থিসিসের টেবুলেশন শিট টেম্পারিং করেন। এমনকি থিসিসের অন্য আরেকজন পরীক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের নিকট গিয়ে ওই শিক্ষার্থীর নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তদবিরও করেন তিনি।

ওই সময় এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগের বর্তমান সভাপতি প্রফেসর ড. আব্দুল হক। এছাড়া পছন্দের প্রার্থী বিভাগের ওই শিক্ষার্থীকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম করার জন্য প্রফেসর শামসুল আলম সরকার অনেক আগে থেকেই চেষ্টা তদবির করে আসছিলেন বলে বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ওই সময় অভিযোগ করেন।

তবে এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে রাবির বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের গ্রুপ সাদা দলের আহ্বায়ক প্রফেসর শামসুল আলম সরকার জাগো নিউজকে  বলেন, ‘গবেষণা কাজে আমি ওই শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার। তবে মাস্টার্সের থিসিসের ক্ষেত্রে সুপারভাইজারের মার্কিং এর কোন সুযোগ থাকে না। শিক্ষকদের একটি রাজনৈতিক দলের আহ্বায়ক হওয়ায় একটি পক্ষ আমার সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট করতে এই নোংরামি করছে।’ এ ব্যাপারে জানতে প্রফেসর ড. আব্দুল হকের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মুহা. রেজাউল করিমকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ছয় মাস পার হলেও তদন্ত কাজে কোন অগ্রগতি দেখাতে পারেননি তারা।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. মো. আল-আমিন সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঠিক কবে কমিটি গঠন করা হয়েছিল মনে নেই। কমিটির সভাপতি এর মধ্যে মাত্র দু’বার আমাদেরকে ডেকেছিল। সভাপতি সভা আহ্বান না করলে সদস্যদের কিছু করার নেই।’

তবে কমিটির সভাপতি প্রফেসর মুহা. রেজাউল করিম বলেন, ‘তদন্ত কাজ ভালভাবে চলছে। খুব দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (রেজাল্ট শাখা) আব্দুল গফুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘নম্বরপত্র টেম্পারিং ও গবেষণাপত্র জালিয়াতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেয়া পর্যন্ত ফল প্রকাশ সম্ভব নয়। বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে সঙ্গে সঙ্গেই ফল প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।’

আরআর/এসএইচএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।