পুরান ঢাকায় সম্প্রীতির সুর সাকরাইন উৎসবে
ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো, তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়। না, ঘুড়ি নির্দিষ্ট কারো আকাশে ওড়ে না, আজ ঘুড়ি ওড়ে সবার আকাশে। পুরান ঢাকাবাসীর অতি আনন্দের উৎসব সাকরাইন। যাকে ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়।
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা পৌষ মাসের শেষ দিন এই উৎসবে মেতে ওঠে রঙিন কাগজ কেটে ঝালর বানিয়ে কিংবা পাখি, ফুল আর নানা ধরনের আকৃতি বানিয়ে বাড়ির ছাদে, জানালায়, বারান্দায় ঝুলিয়ে দেয়। পৌষ মাসের শেষ দিন এই উৎসব শুরু হয় শেষ হয় পহেলা মাঘ।
উনিশ শতকের দিকে পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন উৎসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পালন করলেও সাকরাইন এখন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পুরান ঢাকার সব মানুষের উৎসব। সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবে মেতে ওঠার মাধ্যমে এক অসাম্প্রদায়িক পুরান ঢাকার জানান দিচ্ছে।
আজ পুরান ঢাকার আকাশে চলছে ঘুড়ির রাজত্ব। নানা রঙের ঘুড়ি পুরান ঢাকার আকাশে ছেয়ে গেছে। সন্ধ্যার আয়োজনে ফানুস আর আলোকসজ্জার সাথে চলছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর করোনা মহামারির কারণে উৎসবের আমেজটা কম।
ভোর থেকেই কুয়াশার আবছায়ায় পুরান ঢাকার ছাদে ছাদে শুরু হয় নাটাই-ঘুড়ির উৎসব। ছোট-বড় সবাই মেতেছে এ আনন্দে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উৎসবের জৌলুস। শীতের বিকেলে ঘুড়ির কাটাকাটি খেলার উত্তাপ বাড়তি আনন্দ দেয়।
মাঝে মাঝে ঘুড়ি কেটে গেলে পরাজিত ঘুড়ির উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হচ্ছিল ভোকাট্ট লোট শব্দ। গোধূলী কেটে গেলে থেমে যায় ঘুড়ি উড়ানোর আমেজ। আবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় আতশবাজি, আর তরুণদের জনপ্রিয় খেলা মুখে কেরোসিন নিয়ে হাতে ধরা কাঠি আর মশালের ওপর ফু দিলেই আগুনের উল্কা বেরিয়ে আসে।
পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ, মুরগিটোলা, কাগজিটোলা, গেন্ডারিয়া, বাংলাবাজার, ধূপখোলা মাঠ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, শাঁখারিবাজার, সদরঘাট, কোর্টকাচারি, শিংটোলা এলাকার বিভিন্ন স্থানে চলছে সাকরাইন উৎসব। উৎসবকে ঘিরে বেশ কদিন আগে থেকেই পুরান ঢাকার বেশির ভাগ গলি আর খোলা ছাদে চলছিল সুতা মাঞ্জা দেয়ার ধুম। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলেছিল পুরোদমে।
সাকরাইন দেখতে ঢাকার সাভার থেকে জোগেশ রয় এসেছেন পুরান ঢাকায় তার পিসির বাসায়। তিনি জানান, সাকরাইন আমাদের প্রাণের উৎসব। আমাদের বাসা পুরান ঢাকায় না হলেও প্রতি বছর আমরা পুরো পরিবার সাকরাইন পালন করতে পিসির বাসায় চলে আসি। সকাল থেকে ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের পিঠা খেয়েছি। আমি মনে করি এই সংস্কৃতি শুধু আমাদের হিন্দু ধর্মের নয়। এ সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে হাজার বছর টিকে থাকুক।
জানা যায়, পুরান ঢাকার জামাইরা পৌষ মাসের শেষে শ্বশুরবাড়ি আসতেন। তখন তারা ঘুড়ি ও নাটাই নিয়ে উৎসবে মাততেন। সব বাড়ির জামাই ঘুড়ি উড়ালে উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে তা দেখত এলাকাবাসী। এমনটা এখন আর হয় না। শহরে এখন শীতের তীব্রতা কমে গেছে। ঘুড়ি উৎসব এখন পৌষকে বিদায় দিয়ে মাঘকে বরণ করার উৎসবের অংশ হয়ে গেছে।
এছাড়া পৌষ মাসের শেষ দিন সাকরাইনে নতুন ধানের চালের পিঠাপুলি খেয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করার রেওয়াজ বহু পুরোনো। পুরান ঢাকার মানুষ এ উৎসব পালন করে আসছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। এখন আর আগের মতো সবার ঘরে পিঠা তৈরি হয় না। তবে এখনো কিছু কিছু ঘরে সে সময়ের রেওয়াজ ধরে পিঠা তৈরি করে। পিঠার সংস্কৃতিটা কম হলেও অন্যান্য সংস্কৃতিতে পিছিয়ে নেই এ প্রজন্মের তরুণরা।
উল্লেখ্য, এবার এসো উড়াই ঘুড়ি, ঐতিহ্য লালন করি’ স্লোগান সামনে রেখে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে আয়োজন করা হয় সাকরাইন উৎসব।
রায়হান আহমেদ/এমআরএম/জেআইএম