একাধিক পরিদর্শনেও সুরাহা হচ্ছে না ঠাকুরগাঁওয়ের রেশম কারখানাটির
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানাটি ইজারায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও আলোর মুখ দেখেনি রেশম কারখানাটি।
ঠাকুরগাঁওয়ের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, রাজনীতিক ও জন-প্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতার কারণে এখন পর্যন্ত এই রেশম কারখানাটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। বন্ধ কারখানা চালু করার কথা বলে একাধিকবার সরকারি দল ও বিগত জোট সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো চালু না হওয়ায় হতাশ শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২৪ আগস্টে জাতীয় সংসদ ভবনে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঠাকুরগাঁও ও রাজশাহী রেশম কাখানা চালুর বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে কারখানা দুইটি পুনরায় চালুর সুপারিশ করা হয়।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানা দুইটি বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এই কারখানা দুইটি চালু করার একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল আমাদের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ঠাকুরগাঁও ও রাজশাহীবাসীর জন্য এ কারখানা চালুর ব্যাপারে কমিটমেন্ট ছিলো।
তিনি বলেছিলেন, শুধু একটি কারখানা নতুন করে চালু করলেই হবে না, এটাকে কীভাবে লাভজনক করা যায়, সেসব বিষয়ে ভেবে দেখতে হবে। সেখানে যেসব `র মেটেরিয়াল` রয়েছে সেগুলো উন্নতমানের কিনা ? নতুন প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায় ? উৎপাদনকে কীভাবে লাভজনক করা যায় ?- এসব বিষয়ে ধারণাপত্র তৈরি করতে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল।
কমিটির সভাপতি আরো বলেন, এক মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয় সামগ্রিক ধারণাপত্র দিলে আমরা কারখানা দুইটি চালুর জন্য অর্থায়ন নিয়ে ভাববো। সেক্ষেত্রে সরকারিভাবেও হতে পারে, আবার অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে। একই সঙ্গে কৃষকদের প্রশিক্ষিত করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় রেশম চাষ বাড়ানো যায় কিনা সেটিও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়কে।
সূত্র জানায়, রেশম মিলের উন্নয়নে করণীয় এবং ঠাকুরগাঁও ও রাজশাহীতে বন্ধ রেশম কারখানা চালুর জন্য নতুন মেশিন স্থাপন, নতুন গবেষক নিয়োগ, নতুন তুঁত গাছ লাগানোসহ একটি সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা এবং প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণেরও সুপারিশ করা হলেও তা এখন পর্যন্ত খাতা কলমেই পড়ে রয়েছে।
উল্লেখ্য, জেলার রেশম কারখানাটি ১৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ক্রমাগত লোকসানের ফলে এটি ২০০২ সালে বন্ধ ঘোষণা করার পর আর চালু করা হয়নি। এতে কারখানাটির ১৩৪ জন শ্রমিক ও প্রায় ১০ হাজার রেশম চাষি বেকার হয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়ন, যন্ত্রপাতি পুনরায় স্থাপন ও সম্প্রসারণ (বিএমআরই) করার পরও কারখানাটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতি মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে।
১৯৭৭-৭৮ সালে আরডিআরএস নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ঠাকুরগাঁওয়ের দুরামারি নামক জায়গায় (বর্তমানে বিশিক শিল্প নগরীতে) এই রেশম কারখানাটি স্থাপন করে। পরবর্তীতে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ১৯৮১ সালে কারখানাটি রেশম বোর্ডের কাছে হন্তান্তর করা হয়। ধীরে ধীরে ১০ হাজার চাষি রেশম গুটি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
রেশম বোর্ডের কাছে হস্তান্তরের পর কারখানাটি গত ২৬ বছরে পর্যায়ক্রমে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা লোকসান দেয়। এ লোকসানের অজুহাতে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর কারখনাটি বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা কারখানাটি বন্ধ হওয়ায় এতে কর্মরত ১৩৪ জন শ্রমিক ও প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় রেশম চাষি বেকার হয়ে পড়েন। পরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকদের মাঠে থাকা লাখ লাখ তুঁত গাছ কেটে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করতে বাধ্য হন তারা।
এ ব্যাপরে ঠাকুরগাঁও রেশম বোর্ডের উপ-পরিচালক সুলতান আলী জানান, এখানকার রেশম কারখানটি বন্ধ হওয়ার পরেও প্রায় ২০০ রেশম চাষি বর্তমানে গুটি উৎপাদন করছেন। এতে করে এলাকার কৃষকরা গত বছর প্রায় পাঁচ হাজার কেজি কাচা গুটি বিক্রি করে প্রায় ১১ লাখ টাকা আয় করেছেন।
প্রান্তিক কৃষকদের আয়ের অন্যতম এ মাধ্যমটি গত ১৪ বছর ধরে বন্ধ থাকায় তাদের জীবনযাত্রায় পড়েছে এর প্রভাব। তাই ঠাকুরগাওয়ে দ্বিতীয় ভারী শিল্প কারখানা হিসেবে এই রেশম কারখানাটি চালুর দাবি জানিয়েছেন রেশম চাষিসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
রবিউল এহ্সান রিপন/এআরএ/আরআইপি