বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সমাহিত হলেন খোন্দকার নূরুল আলম
দেশের স্বনামধন্য সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী খোন্দকার নূরুল আলম মারা গেছেন শুক্রবার (২২ জানুয়ারি)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো প্রায় ৮০ বছর। গানের জন্য নিবেদিত এই মানুষটির প্রয়াণে দেশীয় সংগীতাঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
খোন্দকার নূরুল আলমের মরদেহ শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। সেখান থেকে আজ শনিবার সকাল ১১টায় জাতীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
তার একান্তই কাছের মানুষ ও প্রিয় মানুষেরা এসে ছিলেন শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। উপস্থিত ছিলেন তার দীর্ঘ জীবনের সহকর্মী গীতিকার রফিকুজ্জামান, হাসান ইমাম, সুরকার ও সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান, খ্যাতিমান অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানসহ আরো অনেকেই। আরো এসেছিলেন সুজেয় শ্যাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ, শিল্পী ফকির আলমগীর, গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী, কবির বকুল, সংগীতশিল্পী রফিকুল ইসলাম, সংগীত পরিচালক ফুয়াদ নাসের বাবু প্রমুখ। প্রত্যেকেই সজল নয়নে প্রিয় মানুষকে শেষ বিদায় জানিয়েছেন।
প্রিয় বন্ধুবরের স্মৃতিচারণ করে এ টি এম শামসুজ্জামান বলেন, ‘তার মতো এমন আত্মসচেতন মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। কোনো অন্যায়কে কোনোদিন ছোট করে দেখেননি। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি বলেই চির অভিমানে জীবন কাটিয়েছেন। আমি এমন নির্মোহ বন্ধু হয়তো পাব না। বাংলাদেশ হয়তো এমন মেধা ও মননশীল মানুষ পাবে না। তার করা সুরে কণ্ঠ বসিয়ে অনেকেই বিখ্যাত হয়েছেন অথচ আজ চলে যাবার দিনে তেমন কেউ নেই।’
সংগঠনের পক্ষে ফুলের শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সংস্থা, শিল্পকলা একাডেমী, মিউজিশিয়ান ফোরাম, বাংলার মুখ, ক্রান্তি ও বহ্নিশিখা। তার আত্মার শান্তি কামনা করে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক ঘণ্টা শ্রদ্ধা জানানো শেষে মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হয়। সেখানে বাদ-জোহর জানাযা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই বিকেল সাড়ে ৪টায় তাঁকে দাফন করা হয়।
খোন্দকার নূরুল আলম ‘শুভদা’সহ বিভিন্ন ছবিতে গান তৈরি করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন একাধিকবার। পেয়েছেন একুশে পদকও। ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’, ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’ প্রভৃতি কালজয়ী সুর তৈরি করেছেন এ সুরস্রষ্টা।
১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়ী মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন খোন্দকার নুরুল আলম। বাবা নেসারউদ্দিন খন্দকার ও মা ফাতেমা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। মাকে হারান ১৯৪৮ সালে, ১২ বছর বয়সে। একই বছর পুরো পরিবারের সাথে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ১৯৫৯ সালে বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন খোন্দকার নুরুল আলম। ১৯৬০ সালে তিনি ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সুরকার হিসেবে যোগদান করেন। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
‘ইস ধরতি পার’-এর মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হন খোন্দকার নুরুল আলম। ১৯৬৮ সালে ‘অন্তরঙ্গ’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’ বাংলা ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। সে সময় ‘যে আগুনে পুড়ি’র ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
এরপর আর থেমে থাকেননি, স্বাধীনতার পর ‘ওরা ১১ জন’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন খোন্দকার নুরুল আলম। অসংখ্য কালজয়ী ছবিতে রয়েছে তার সুর করা ও গাওয়া গান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘সংগ্রাম’, ‘জলছবি’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রভৃতি।
সংগীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন খোন্দকার নুরুল আলম।
এলএ