সংস্কৃতির উপর হামলার বিচার চায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ
সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে দেশব্যাপী সুখ্যাতি রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার। উপ মহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। এছাড়া কালজয়ী উপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, জ্যোতিরীন্দ্র নন্দী, উস্তাদ আয়াত আলী খাঁ সহ অনেক গুণীজনের জন্ম এই জেলাতেই। সেই সূত্রে সংস্কৃতির এই রাজধানীতে রয়েছে অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। এসব সংগঠনে সুস্থ্য ধারার সংস্কৃতি চর্চা চলে অবিরাম।
তবে গত মঙ্গলবার একদল বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্র সংস্কৃতি অঙ্গণে যে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে তা আগে কোনোদিন ঘটেনি এখানে। স্বাধীনতার পর এমন ধ্বংসযজ্ঞও কোনোদিন দেখেনি স্থানীয়রা। সেদিন বিক্ষুব্ধরা শহরের পুরাতন জেল রোডস্থ সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে। হামলাকারীরা সংগীতাঙ্গনের মিউজিয়ামে রক্ষিত উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি বিজড়িত নানা জিনিসপত্রে অগ্নিসংযোগ করে। এর ফলে এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে সেটি।
হামলার সাক্ষী হয়ে এখনো সংগীতাঙ্গনের সেই খোলা জায়গায় পড়ে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া চেয়ার-টেবিল, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত মূল্যবান জিনিসপত্র।
সেদিনের সেই ভয়াবহ হামলার বর্ণণা দিয়ে উস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে একদল বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্র এবং যুবক অতর্কিতভাবে সংগীতাঙ্গনে ঢুকে হামলা চালায়। হামলাকারীরা সংগীতাঙ্গনের চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য আসবাপত্র ভাঙচুর করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। যাওয়ার সময় হামলাকারীরা সংগীতাঙ্গনের মিউজিয়ামে রক্ষিত উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র ‘সরোদ’, হারমোনিয়াম-তবলা, বিছানা, জায়নামাজ, বই, কিছু দুর্লভ ছবি, রাজা-জমিদারদের দেয়া উপহারসহ নানা জিনিসপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেয়।’
তবে শুধুমাত্র আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনে হামলা করেই ক্ষান্ত হননি বিক্ষুব্ধরা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়- তারা শহরের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্ত্বরেও তাণ্ডব চালিয়েছে। হামলাকারীরা ভাষা চত্ত্বরে বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় এবং বঙ্গ-সংস্কৃতি উৎসব অনুষ্ঠানের মঞ্চ ভাঙচুর করেন।
এ ব্যাপারে তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের পরিচালক মো. মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের অবকাঠামোগত যে ক্ষতি হয়েছে সেটি হয়তো সংস্কার করা যাবে কিন্তু উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সংগীতাঙ্গণের এই ক্ষতি অপূরণীয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্প-সাহিত্যে এমন হামলার ঘটনা আগে কোনোদিন ঘটেনি। এই হামলায় সংস্কৃতি অঙ্গনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোদিন শুকাবার নয়।’
তবে গত সোমবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনের দরদামের মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষের পর মঙ্গলবার কেন শহরজুড়ে বিভিন্ন স্থাপনায় তাণ্ডব চালানো হয়েছে তা নিয়েও এখন জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
সংস্কৃতি অঙ্গনে এই হামলার ঘটনায় সংস্কৃতি কর্মীদের মাঝে আতঙ্কের পাশাপাশি চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন স্বাধীন বাংলাদেশে আগে কোনোদিন সাংস্কৃতিক অঙ্গণে এমন তাণ্ডবের ঘটনা ঘটেনি। এই হামলার পেছনে স্বাধীনতা বিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি সরাসরি জড়িত।
এইসব হামলায় বাকরুদ্ধ হয়ে আছে বি বাড়িয়ার মানুষ ও সংস্কৃতি কর্মীরা। তারা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না একজন ছাত্রের মৃত্যুর জন্য উস্তাদ আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন কিংবা অন্যান্য সরকারি স্থাপনা ও সংস্কৃতি সংগঠনের কী দায় বা অপরাধ? এই প্রশ্ন তারা রেখেছেন রাষ্ট্রের কর্তব্যক্তিদের জন্য। তারা বিশেষ করে বলেন, দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রি যখন আসাদুজ্জাম নূরের মতো দেশ বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তখন সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলার বিচার মানুষের পাওয়া উচিত। অথচ তিনদিন পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। এটা অত্যন্ত বেদনার। এলাকাবাসী এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও দাবি করেছেন অনতিবিলম্বে।
আজিজুল আলম সঞ্চয়/এলএ