শিক্ষাগত যোগ্যতায় এগিয়ে আ.লীগ, অর্থ-সম্পদে গঙ্গামানিক
রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে এবার মুখোমুখি হয়েছেন দুই মেয়র। সাবেক মেয়র আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. হাবিবুর রহমান হাবিব ১৯৯৭ সালে এ পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং ২০০৪ সালে মেয়র নির্বাচিত হন। আর বর্তমান মেয়র বিএনপির সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টো নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১১ সালে। তিনি পদত্যাগ করে আবারও মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। এ দুই প্রার্থীসহ এবার রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে লড়ছেন মোট সাত প্রার্থী।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামার তথ্য বিবরণীতে দেখা যায়, কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আকবর হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং বিএনপি প্রার্থী সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আটটি মামলা ছিল। তবে ইতোমধ্যে উভয় প্রার্থীর সবগুলো মামলার নিষ্পত্তি, খালাস ও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হলেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী আকবর হোসেন চৌধুরী। আর অর্থ-সম্পদে এগিয়ে জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী গঙ্গামানিক চাকমা।
আকবর হোসেন চৌধুরী ১৯৯৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর বিএনপি প্রার্থী বর্তমান মেয়র সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টো, বিদ্রোহী প্রার্থী রবিউল আলম রবি এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব এইচএসসি পাস করেছেন। আওয়ামী লীগের আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী অমর কুমার দে স্বশিক্ষিত, জাতীয় পার্টির শিব প্রসাদ মিশ্র অষ্টম শ্রেণি এবং জনসংহতি সমিতির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী গঙ্গামানিক চাকমা হোমিওপ্যাথিতে ডি.এইচ.এম.এস পাস করেছেন।
হলফনামায় দেয়া তথ্য মতে, এ পৌরসভার সাত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ভূট্টো, আকবর হোসেন চৌধুরী, হাবিবুর রহমান হাবিব, রবিউল আলম ও অমর কুমার দে পেশায় ব্যবসায়ী এবং গঙ্গামানিক চাকমা ও শিব প্রসাদ মিশ্র হোমিও চিকিৎসক।
সম্পদ ও আর্থিক বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, গঙ্গামানিক চাকমার বার্ষিক আয় ৭ লাখ টাকা। নিজ নামে বাড়ি ও নগদ এক লাখ ৫০ হাজার টাকা আছে। স্ত্রীর নামে রয়েছে ৫০ হাজার টাকা। স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ নিজের ৩০ হাজার এবং স্ত্রীর নামে ৩০ হাজার টাকা। স্ত্রীর কাছে আছে ৩০ ভরি স্বর্ণ। কৃষি জমি নিজ নামে ৫ একর, স্ত্রীর নামে ৫ একর এবং নির্ভরশীলদের নামে ১০ একর রয়েছে।
আকবর হোসেন চৌধুরীর বার্ষিক আয় দুই লাখ ৭২ হাজার টাকা। নগদ রয়েছে এক লাখ টাকা এবং বরকল উপজেলার হরিণা বাজারে আছে একটি দোকান। হাবিবুর রহমানের বার্ষিক আয় ৯২ হাজার ৯৪০ টাকা এবং স্ত্রীর কাছে রয়েছে পাঁচ ভরি স্বর্ণ।
সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর বার্ষিক আয় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। নগদ রয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর কাছে আছে তিন ভরি স্বর্ণ। এছাড়া কৃষি জমি, বসতভিটা ও বাড়ি রয়েছে যৌথ মালিকানায়।
ব্যবসায় রবিউল আলমের বার্ষিক আয় তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা। তার নগদ আছে এক লাখ টাকা এবং স্ত্রীর আছে পাঁচ ভরি স্বর্ণ। শিব প্রসাদ মিশ্রর বার্ষিক আয় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা এবং অমর কুমার দের বার্ষিক আয় দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা।
হলফনামায় উল্লেখ করেছেন সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, আকবর হোসেন চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও রবিউল আলম নির্বাচনে ব্যয় মেটাবেন নিজস্ব আয় ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার ও সাহায্য নিয়ে। আর গঙ্গামানিক চাকমা, শিব প্রসাদ মিশ্র ও অমর কুমার দে খরচ করবেন নিজস্ব আয় থেকে।
এদিকে, প্রথম শ্রেণির রাঙামাটি পৌরসভা নির্বাচনে সাত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচিত হয়ে হাবিবুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম চৌধুরী ইতোমধ্যে পৌরবাসীর কাছে পরীক্ষিত হয়েছেন। তারা এবারও লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনে হাজির হয়েছেন পৌরবাসীর কাছে। তারা পৌর এলাকার উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা দিতে বহুবিধ কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন পৌরবাসীকে। বাকিদের মধ্যে মেয়র পদে নতুন হলেও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে পরপর দুই মেয়াদে রবিউল আলম রবি এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডে গত নির্বাচনে শিব প্রসাদ মিশ্র কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই তারাও পরীক্ষিত।
আকবর হোসেন চৌধুরী, গঙ্গামানিক চাকমা ও অমর কুমার দে নির্বাচনে এবারই প্রথমবারের মতো হাজির হয়েছেন পৌরবাসীর সামনে। তারা প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে ভোটারদের আশ্বস্ত করে বলছেন, উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধায় এ পৌরসভা আজও অনেক পিছিয়ে। অতীতে যারা ছিলেন নিজের সুবিধা ফায়দা লুটতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। রাঙামাটি পৌরসভাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তারা। প্রতিশ্রুতিতে সবার মুখে মধুর সুর। জয়লাভের জন্য দিনরাত অবিরাম ছুটছেন ভোটারদের বাড়ি বাড়ি।
অন্যদিকে, আগে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন দায়িত্বে থাকাকালে তারা কে কি কাজ করেছেন এবং নতুনরা কাজ করতে কতটুকু আন্তরিক ও সৎ এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন পৌর এলাকার জনগণ। যার চূড়ান্ত রায় হবে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে।
ভোটাররা বলছেন, প্রার্থী সবাই যোগ্য। শিক্ষাগত যোগ্যতা যেই হোক কাউকে অযোগ্য বলা যাবে না। অযোগ্য হলে মেয়র পদে প্রার্থী হতে পারতেন না। কিন্তু আমরা যাকে যোগ্য বিবেচনা করে ভোট দেব তাকে নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে কাজ করতে হবে। নাগরিকদের সেবায় এবং সুবিধায় নিশ্চয়তা চাই।
সাংবাদিক কামাল উদ্দিন, ব্যবসায়ী রতন মিয়া, শ্রমিক রাশেদ, অন্য পেশাজীবী অমর চাকমা, স্মৃতিময় চাকমা, গৃহবধূ মেথুইচিং মারমা, হালিমা বেগম, কলেজ ছাত্রী এন্টিমণি চাকমা তারা সবাই ভোটার। আলাপকালে তারা বলেন, দলবল বুঝি না যাকে পৌরবাসীর সেবা, নাগরিক সুবিধা ও উন্নয়নে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন বলে যোগ্য মনে করব তাকেই ভোট দেব।
সাবেক মেয়র হাবিবুর রহমান ১৯৯৯ সালে চেয়ারম্যান এবং ২০০৪ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সমর্থনে। এবারও দল থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু পাননি।
এবার নির্বাচনে জগ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের এই বিদ্রোহী প্রার্থী বলেন, আমি পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্বে থাকাকালে এ পৌর এলাকার অনেক উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা দেয়া হয়েছে। ১৯৭২ সালে সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সময়ে তা হয়নি। আমি পৌর ট্রাক টার্মিনাল, পৌর সুপার মার্কেট, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। শহরে একটা রাস্তাও কাঁচা রেখে যায়নি আমি। এছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহসহ শতভাগ স্যানিটেশন কাভারজে দিয়েছি। সেজন্য এ পৌর এলাকার মানুষ আমাকে আবারও মেয়র হিসেবে পেতে চায় বলে আমাকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।
বিএনপি প্রার্থী সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, গত নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর রাঙামাটি পৌরসভাকে আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে শহরে সৌন্দর্য্যবর্ধন, পার্ক, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, বস্তি উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অনেক কিছু কাজ করার উদ্যোগ ছিল তার। কিন্তু আওয়ামী লীগের বাধার মুখে কাঙ্খিত লক্ষ্যে কাজ করতে পারিনি।
তিনি বলেন, গত মেয়াদের একদম শেষের দিকে পৌর এলাকার উন্নয়নে প্রায় একশ’ কোটি টাকার কিছু প্রকল্প অনুমোদন নিয়েছি। এবার নির্বাচিত হলে দ্রুত গতিতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করবো। এছাড়া পৌরবাসীর নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাসহ সবক্ষেত্রে উন্নয়নে কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আকবর হোসেন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, রাঙামাটি একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে এখানে তুলনামূলকভাবে আজও তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। যা হওয়ার কথা ছিল সেগুলো নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সফল হতে পারেনি। আমি নির্বাচিত হলে প্রথম শ্রেণির এ পৌরসভাকে আধুনিক পর্যটন ও পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এখানে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠী মানুষের বসবাস। আমি নির্বাচিত হলে রাঙামাটি শহরকে সম্প্রীতির শহর হিসেবে উপহার দিতে চাই।
জনসংহতি সমিতির সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ডা. গঙ্গামানিক চাকমা রাঙামাটি পৌর এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ়, পৌরবাসীর সেবা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতসহ পৌর এলাকার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবো।
রবিউল আলম রবি জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিগত সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি নির্বাচিত হলে উন্নয়ন ও নাগরিক সেবায় দ্রুত এ পৌরসভার দৃশ্যপট বদলে দেব।
অমর কুমার দে জাগো নিউজকে বলেন, অতীতে এ পৌর এলাকার কাঙ্খিত উন্নয়ন ও পৌরবাসীর নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কেউ কাজ করেননি। উন্নয়নের নামে কেবল লুটপাট হয়েছে। অনিয়ম আর দুর্নীতি ছাড়া পৌরবাসী কিছুই দেখেননি। আমি নির্বাচিত হলে আধুনিক সুন্দর পর্যটন নগীর হিসেবে গড়ে তুলবো এ পৌরসভাকে।
শিব প্রসাদ মিশ্র জাগো নিউজকে বলেন, আমি নির্বাচিত হলে এ পৌর এলাকার উন্নয়ন ও পৌরবাসীর নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে নতুন চমক দেখাব।
সুশীল প্রসাদ চাকমা/এমজেড/এমএস