মুক্তিযোদ্ধা মন্টুর সফলতার কাহিনী
১৯৭১ সাল। জাকির হোসেন মন্টু তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি প্রস্তুতি নিতে চলে যান ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। প্রশিক্ষণ শেষে ৭ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। গেরিলা ও সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছেন দিনাজপুরের হিলি, জয়পুরহাটের কড়িয়া, পাগলা দেওয়ান বর্ডার, নওগাঁর ধামুরইরহাটসহ বিভিন্ন জায়গায়।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে স্বাধীনতার এই বীরসেনা বলেন, এক রাতে পাঁচবিবির কড়িয়া এলাকায় ৮-১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তারা পাঞ্জাবিদের ব্যাংকারের উপর হামলা করার প্রস্ততি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় ৫০ গজ দূরে একটি শৃগাল আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে দৌড় দেয়। কিন্তু মাটিতে পুঁতে রাখা মাইন এর উপর পা দিতেই তা বিস্ফোরিত হয়ে শৃগালটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যায়। আমাদের জন্য পুঁতে রাখা সেই মাইন বিষ্ফোরিত হয়ে শৃগালটি মারা যাওয়ায় আমরা সকলে মর্মাহত হলেও প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় আমরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করি।
এর কিছুদিন পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জার্নাল সিং, আমি এবং আমার দলের কয়েকজন সদস্য ডিসেম্বরের প্রথম দিকে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত পরিদর্শন করি। সন্ধ্যায় ভারতীয় মারাঠা রেজিমেন্ট এর সেনাসদস্যসহ মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলে সেখানে সম্মুখ যুদ্ধে রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েক শত যোদ্ধা হতাহত হন। সে কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে উঠি।
এভাবে যুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভোরের দিকে ভারতের সেনা কমান্ডার ডোগরা সিং এর নির্দেশে আমার নেতৃত্বে ৩৬ জন ও কমান্ডার আসাদুজ্জামান বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভূঁইডোবা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচবিবি এলাকায় প্রবেশ করি।
এরপর একই দিন সকালে পাঁচবিবি লাল বিহারী হাইস্কুল মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়ান আমার দলের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা মোতালেব। আবার ওইদিনই জয়পুরহাট সদরের ডাক বাংলোতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন আসাদুজ্জামান ওরফে বাঘা বাবলু। যুদ্ধকালীন হানাদাররা জয়পুরহাট শহরের খঞ্জনপুর এলাকায় আমার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন আমার পরিবারের সদস্যরা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বগুড়ার শুকানপুকুর আমার মামার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে থেকে ফিরে আমার গ্রাম খঞ্জনপুর এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় হানাদারদের তাণ্ডব চোখে পড়ে।
যুদ্ধ থেকে ফিরে আমি ১৯৭২ সালে জয়পুরহাট ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি কমার্স বিভাগে ভর্তি হয়ে পাস করার পর ঢাকা জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু অর্থাভাবে সেখানে পড়াশুনা করতে না পারায় ফিরে এসে জয়পুরহাট ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৭৫ সালে বিএ পাস করি।
তারপর ১৯৭৬ সালে জয়পুরহাট চিনিকলে চাকরি নিয়ে ৮-১০ বছর চাকরি করার পর সৌদি আরবে চলে যাই। সেখানে ৫-৬ বছর থাকার পর দেশে ফিরে আসি। সৌদিতে যাওয়ার আগে ১৯৮০ সালে বিয়ে করি।
১৯৮৪ সালে আমার বড় মেয়ে নিলুফার সরকার নিপা ও ১৯৯২ সালে ছোট মেয়ে ফারহা দিবা সরকার জন্মগ্রহণ করে। অর্থাভাবে যেমন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি কিন্ত আমার ইচ্ছা ছিল মেয়ে দুটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব। আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন।
আমার বড় মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রোনোমি অ্যান্ড এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করার পর বর্তমানে ৩৪তম বিসিএস এ উত্তীর্ণ হওয়ার পর বর্তমানে গেজেটের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করি সে সহকারী কমিশনার হিসেবে চাকরি পাবে। ছোট মেয়েও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের মত জীবনযুদ্ধেও জয়ী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জয়পুরহাট জেলা ইউনিটের সাংগঠনিক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মন্টু জানান, দেশটা স্বাধীন হলো বলে আমার মত দেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন মুক্ত, স্বাধীন।
এসএস/এমএস