শেরপুর মুক্ত হয় এই দিনে
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে পাক হানাদারদের দখল হতে শেরপুর জেলা মুক্ত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। গৌরব গাঁথা সে দিনটির কথা শেরপুরবাসীর স্মৃতিতে আজও ভাস্বর হয়ে আছে।
সেইদিন একদিকে ছিল যেমন বিজয়ের অনাবিল আনন্দ, অপরদিকে স্বজনহারাদের আহাজারি। এর মাঝে শেরপুর টাউনে শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্ক মাঠে হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করেছিলেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা। এখানে দাঁড়িয়েই তিনি বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, মস্কো, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ দিনটি শেরপুর জেলার আপামর জসসাধারণের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যময়, গৌরবোজ্জ্বল ও অবিস্মরণীয় দিন।
মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীন। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস জেলার বর্তমান ৫টি উপজেলার ৩০/৪০টি এলাকায় ছোট বড় যুদ্ধ হয়েছে। এ সমস্ত যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন ৮৪ জন বীর সন্তান। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ। ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নারী, পুরুষ, শিশুসহ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সোহাগপুর গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় বিধবাপল্লী।
শ্রীবরদীর জগৎপর গ্রামে পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে হত্যা করে ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী ও গ্রামে আশ্রয় নেয়া মানুষদের। ২৪ নভেম্বর সদর উপজেলার সূর্য্যদী গ্রামে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন ৬৯ জন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য এ জেলার একজন বীরবিক্রম, দুইজন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন। এরা হলেন- ‘শহীদ শাহ মুনতাসীম বিল্লাহ খুররম বীর বিক্রম’, ‘কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি বীর প্রতীক’ ও ‘ডা. মাহমুদুর রহমান বীর প্রতীক’। এ তিন বীর সন্তানই শ্রীবরদী উপজেলার বাসিন্দা।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শেরপুরে শত্রু সেনাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ি এবং পার্শ্ববর্তী বকশীগঞ্জ অঞ্চলে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা লড়াই। এ লড়াই চূড়ান্ত রূপ নেয়া শুরু হয় নভেম্বর মাসে। এ মাসের শেষ সপ্তাহে শেরপুর-জামালপুর সেক্টরে পাকবাহিনীর দূর্জেয় ঘাঁটি হিসেবে কথিত জামালপুর ক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ফলে ৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর এ দূর্জেয় ঘাঁটির পতন ঘটে। তারা পরাজয় নিশ্চিত জেনে দ্রুত এ অঞ্চল থেকে সরে যেতে শুরু করে।
ঝিনাইগাতীর আহমদনগর সেক্টর হেডকোয়ার্টারসহ ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর ত্যাগ করে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জামালপুরে আশ্রয় নেয়। পাকবাহিনীকে জামালপুর থেকে হটাতে গিয়ে ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর ৬ জওয়ান শেরপুরে শহীদ হন। অপরদিকে, ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ি ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্ত পথে ৭ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধার দল যথাক্রমে ক্যাপ্টেন আজিজ, জাফর ইকবাল ও রুহুল আমিন তোতার নেতৃত্বে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে।
এ দিন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টারযোগে স্থানীয় শহীদ দারোগ আলী পৌর মাঠে অবতরণ করেন। মুক্ত শেরপুরবাসী তাকে স্বাগত জানায়। মিত্রবাহিনীর উপস্থিতিতে সেদিন পৌর মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে উপস্থিত জনতা চারদিক মুখরিত করে তোলে। এখানে দাঁড়িয়েই জগজিৎ সিং অরোরা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, মস্কো, আকাশবাণীসহ বিভিন্ন বেতার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামায়াত নেতা কামারুজ্জামান শেরপুর অঞ্চলে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তখন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। কামারুজ্জামানের সহযোগী হিসেবে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা কামরান, নাসির, কামাল। তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ডা. সামেদুল হক, তজম্মল চৌধুরী শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় এ বছরের এপ্রিল মাসে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ বলেন, দেরিতে হলেও দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। এ বিচার আমাদের বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবে। তরুণ প্রজন্ম আজ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে জেগে উঠেছে। এটা আমাদের বেশ আশান্বিত করেছে যে বাঙালি মাথা নোয়াবার নয়। ইতোমধ্যে আমাদের এলাকার আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়েছে। দেশের আরও কয়েক যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, অনেকের ফাঁসির দণ্ড হয়েছে। আমরা অন্যান্য যুদ্ধপরাধীদেরও ফাঁসি দেখে মরতে চাই।
এক নজরে শেরপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য :
শেরপুর হানাদার মুক্ত হয় : ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১।
শেরপুর জেলায় মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা : ১,৪৬৫ জন (বর্তমানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা : ৯৮০ জন)
মোট শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা : ৮৪ জন
ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা : ১,৩১৯ জন
যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতাপ্রাপ্ত : ১০০ জন
জেলায় মুক্তিযুদ্ধে মোট শহীদের সংখ্যা : প্রায় ১০০০ (ধারণাগত) (সোহাগপুর বিধবাপল্লী-২৫০, সূয্যদী-৬২, জগৎপুর-৬১, ঝাউগড়া-৮, নাকগাঁও-৩২)।
অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা : বর্তমানে জীবিতদের মধ্যে প্রায় ৮০০।
বধ্যভূমি ও গণকবর : ১৩ টি (আহমদনগর-ঝিনাইগাতী, কোয়ারী রোড-ঝিনাইগাতী, বগাডুবি ব্রিজ-ঝিনাইগাতী, রাঙামাটিয়া-ঝিনাইগাতী, নাকুগাঁও-নালিতাবাড়ী, সোহাগপুর বিধবাপল্লী-নালিতাবাড়ী, রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট বিট অফিস-নালিতাবাড়ী, কর্ণঝোড়া-শ্রীবরদী, বালিজুড়ি-শ্রীবরদী, জগৎপুর-শ্রীবরদী, শেরী ব্রিজ-শেরপুর সদর ও থানার সম্মুখে সামাদ সাহেবের বাড়ি-শেরপুর সদর)।
এসএস/এমএস