শহীদ ডা. মিলন : দেশমাতৃকার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ


প্রকাশিত: ০২:৪২ এএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৫

খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জিকায় ৩৬৫ দিনে এক বছর; ৩৬৬ দিনে অধিবর্ষ। একটি বছর আবার বিভক্ত নির্দিষ্ট নামের বারোটি মাসে। কোনো মাস ২৮ বা ২৯ দিনে আবার কোনো কোন মাস ৩০ বা ৩১ দিনে।  প্রত্যেকটি মাসের ঘরই অংক সংখ্যায় এই দিন গুলো লেখা থাকে। একই নিয়মে সকল দেশে মাস আসে মাস যায়; বছর আসে বছর যায়, বর্ষ পরিক্রমায়। কিছু কিছু দিন বা তারিখ আছে যা সকল দেশের জন্যই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অথবা দুঃখ-বেদনার অথবা স্মরণীয় অথবা আবেগে উদ্বেলিত অথবা শ্রদ্ধায় নত শীর। আবার এমন কিছু দিন আছে যা কেবল নির্দিষ্ট কোনো দেশের মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, দুঃখ-বেদনা, শ্রদ্ধায় স্মরণীয় বা ঘৃণায় প্রত্যাখাত।

যেমন বাংলাদেশে খ্রিস্টীয় বর্ষ পঞ্জিকায় ১০ জানুয়ারি  জাতির জনকের স্বদেশাগমনের দিন, ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের গৌরবদীপ্ত দিন, ২৫ শে মার্চ ভয়াল কালো অমানিশার রাত, ১৫ আগস্ট পিতা হারা শোকে মুহ্যমান জাতি, ১৬ ডিসেম্বর আনন্দে আত্মহারা বিজয়ী জাতি; তেমনি ২৭ নভেম্বর এদেশের চিকিৎসক সমাজ তথা গোটা জাতির জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। সেনা শাসকের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার দিন। কি হয়েছিল সেদিন? কেমন ছিল সেদিনের ঢাকা?

ঢাকা ১৯৯০ সাল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স মাত্র ২০ বছর। যে লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭১ সালে তৎকালীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-যুবক,শিক্ষক-চিকিৎসক, কৃষক-শ্রমিক-জনতাসহ সকল পেশার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে  পড়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশী-বিদেশী  চক্রান্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে লক্ষ্যচ্যুত হয় বাংলাদেশ। আবার এদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈরশাসন। সেই স্বৈরশাসকের নাগপাশ ছিন্ন করে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর হিসেবে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিল ১৯৯০ সাল। ১৯৯০ সাল ঢাকার রাজপথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এসেছিল সকল মতের, সকল পেশার মানুষ লক্ষ্য একটাই “ স্বৈরশাসকের পতন, গণতন্ত্রের উত্তরণ” তাই ঢাকা শহর পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে।

বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা ও চিকিৎসা পেশার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ২৩ দফার ভিত্তিতে যখন অগণতান্ত্রিক সামরিক স্বৈর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই সামরিক স্বৈরাচারের দোসর ডা. জাফরুল্লাহ গংদের সহায়তায় ১৯৯০ সালে এদেশের জনগণের উপর টিক্কা খান স্টাইলে চাপিয়ে দেওয়া হয় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি। ১৯৫২‘র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মদানকারী চিকিৎসক সমাজ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে অন্য সকল পেশাজীবীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার বিরোধীগণ আন্দোলনকে আরো বেগবান করে।

অতঃপর ২৭ নভেম্বর ১৯৯০। সারাদেশে  স্বৈরাচার সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএমএ’র নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারা দেশে চলছিল চিকিৎসকদের কর্মবিরতি। তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চলছিল বিএমএ আহুত চিকিৎসক সমাবেশ। চিকিৎসক সমাবেশে যোগদানের লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে রিকশা যোগে শাহবাগ পিজি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও  যুগ্ম-সম্পাদক ডা. শামসুল আলম খান মিলন। পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সংলগ্ন টিএসসি মোড় অতিক্রমকালে তাঁদের রিকশা লক্ষ্য করে গুলি চালায় সামরিক জান্তাবাহিনী। বুকে গুলি লেগে রিকশা থেকে লুটিয়ে পড়েন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। সঙ্গে সঙ্গে রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা করেও বাঁচানো যায়নি স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সাহসী সৈনিক ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। তাঁর প্রিয় মেডিকেল কলেজেই সকলকে কাঁদিয়ে শহীদের বেশে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। যে কলেজে তিনি পড়েছেন মেধাবী ছাত্র হিসেবে,  পড়িয়েছেন বিনয়ী শিক্ষক হিসেবে, নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রাঞ্জল সদালাপী পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তি হিসেবে। ডা. মিলন শহীদ হওয়ার পর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয় ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের। গণতন্ত্রের উত্তরণের পথে প্রাথমিক বিজয় সূচিত হয়। সার্থক হয় মিলনের আত্মদান।

শহীদ ডা. শাসুল আলম খান মিলন একটি অনন্য অসাধারণ নাম। ১৯৫৭ সালের ২৯শে জানুয়ারী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন ডা. শামসুল আলম খান মিলন। ১৯৭৫ সালের ২রা ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হিসেবে কর্মময় জীবন শুরু করেন। ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নশীপ চলাকালীন তিনি ইন্টার্নী চিকিৎক সংগঠরে আহবায়ক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডা. শামসুল আলম খান মিলনের সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুযোগ হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। তখন বিএমএ নির্বাচনে  ডা. শামসুল আলম খান মিলন যুগ্ম-সম্পাদক  ও আমি দপ্তর সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। সেই থেকে একইসাথে সংগঠনের হয়ে কাজ করা। দুটি ভিন্ন প্যানেল থেকে আমরা নির্বাচিত হলেও বিএমএ’র কাজে বা পেশাগত কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কোন মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হত না। একে অপরের সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে পেশার জন্য অটল থেকে কাজ করেছি। সে চিকিৎসকদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ চিকিৎসকদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় ছিল, যা তাঁর নির্বাচিত হয়ে আসা থেকেই পরিলক্ষিত হয়। বিএমএ’র কার্যক্রমে অভিন্ন মনোভাব নিয়ে আমরা সকলে কাজ করি এবং সকল আন্দোলনে জেল-জুলুম, ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে পেশার স্বার্থে মিলন ও আমরা ছিলাম নির্ভীক।  ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিএমএ’র বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি ও স্বৈরশাসকের অন্যায় অথ্যাচারের প্রতিবাদে সকল চিকিৎসক সরকারি চাকুরি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। মঞ্চ থেকে নেমে আমি আর মিলন এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ঐ সময় বিবিসি রেডিও টেলিফোনে বিএমএ নেতাদের সাক্ষাৎকার নেয় । ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসি রেডিওতে আমার যে সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হয় তাতে মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বলতে সহযোগিতা করেছিল।

আজ ২৭ নভেম্বর ২০১৫। শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন এর পঁচিশতম শাহাদাত বার্ষিকী। দেখতে দেখতে পঁচিশটি বছর কেটে গেল । সহযোদ্ধা ডা. মিলনের শাহাদাত বার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মন ভারাক্রান্ত। আজকের দিনে আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ডা. মিলনের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মুত্যু ছিল না । এ আত্মদান ছিল দেশের সাধারণ ও বৃহত্তর মানুষের মঙ্গলের জন্য। ডা. মিলন ছিল অতিমাত্রায় একজন সমাজ সচেতন মানুষ। তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা  ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল এদেশের হাজার হাজার চিকিৎসকদের  প্রতি, চিকিৎসা পেশার প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি।  মাঝে  মধ্যে হোঁচট খেলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বয়সও পঁচিশ বছর। ডা. মিলন যে আদর্শ ধারণ করে, যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগ্রাম করতে করতে আত্মাহুতি দিয়েছিল অনেক হতাশার পর ১৯৯৬-২০০১ ও  ২০০৮ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মেয়াদে দায়িত্বরত জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক সরকার তার অনেকটাই বাস্তবায়িত করেছে। গণমুখি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১২ প্রণয়ন, ১৩৬২ আইএসটি শিক্ষক-চিকিৎসকদের চাকুরি নিয়মিত করা,  ডিপিসির মাধ্যমে হাজার হাজার চিকিৎসক-শিক্ষক-কর্মকর্তার পদোন্নতি, নতুন নতুন পদ ও বিভাগ সৃষ্টি, বেকার চিকিৎসকদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসকদের মর্যাদা বৃদ্ধি,  উচ্চতর ও উন্নত চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ চট্টগ্রাম-রাজশাহীতে আরো দুটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ, নতুন নতুন সরকারি মেডিকেল কলেজ-বিশেষায়িত মেডিকেল ইনস্টিটিউট-নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিশু-মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠা অন্যতম। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ আজ বিশ্বে রোল মডেল। স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাতিসংঘের এমডিজি এ্যাওয়ার্ড,  সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে।

সম্প্রতি সরকার সকল জনগণের জন্য স্বাস্থ্য বীমা ও মেডিকেল হেলথ কার্ড প্রবর্তণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন যার ফলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সার্বিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হবে। নতুন জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৪ প্রণয়নের দিকে অনেক দুর এগিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সেবার মান আরো বৃদ্ধির লক্ষ্যে অচিরেই জাতীয় এ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড কাজ করবে।

আজকের দিনে আমার প্রত্যাশা বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার অচিরেই বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে নিয়োজিত প্রায় ২৫ হাজার চিকিৎসক কর্মকর্তার সাথে অন্যান্য পেশার বা ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য দূর হবে, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখাসহ বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের ন্যায় টেকনিক্যাল ক্যাডার হিসাবে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারও পরিচালিত হবে, কর্মস্থলের চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও চিকিৎসা অবকাঠামো নির্মাণ  হবে, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে গ্রামীণ জনপদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট উন্নত চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য ও সম্প্রসারিত হবে।

লেখক :  প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন (বিএমএ) এর বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও অব্যবহিত সাবেক মহাসচিব । সাবেক কোষাধ্যক্ষ (তিন বার), সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তর সম্পাদক।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।