রোগী মরে গেলেও কিছু করার নেই
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চৌহদ্দিতে অসুস্থ স্ত্রী রেহানা বেগমকে নিয়ে আড়াই ঘণ্টা লাটিমের মতো চক্কর কেটেছেন কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা মিঠু মিয়া। তার স্ত্রী প্রচণ্ড পেটের ব্যথায় বার বার কুঁকড়ে কেঁদে উঠছেন। উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে রোগীর বৃদ্ধ বাবা ও শাশুড়ি এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন।
বুধবার সকাল ১০টায় রেহানাকে তার স্বজনরা জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে ২১২ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠান। সেখানে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জরুরিভিত্তিতে ‘আর্জেন্ট’ লিখে দিয়ে দ্রুত এক্সরে অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ থেকে আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে আনতে বলেন। আলট্রাসনোগ্রাম কক্ষের বাইরে বেঞ্চে বসে পেট চেপে ধরে কাঁদতে লাগলেন রেহানা বেগম।
কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর আলট্রাসনোগ্রাম কক্ষের বাইরে কর্তব্যরত ওয়ার্ড বয় তাকে টাকা জমা দিতে অদূরে একটি কক্ষে পাঠান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন এখন টাকা জমা দিলেও বিকেল ৩টার আগে আলট্রাসনোগ্রাম হবে না।
এ কথা শুনে মিঠু মিয়া বলেন, আমার স্ত্রীর মরণাপন্ন অবস্থা, প্লিজ কিছু করেন, জরুরি চিকিৎসা না পেলে মরেও যেতে পারে, এই দেখেন ডাক্তার সাহেব জরুরি লিখে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আকুতি শুনেও যিনি টাকা নিয়ে সিরিয়াল দেন তার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই চেহারায়!
বার দুয়েক একই কথা বলার পর তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘রোগী মরে গেলেও আমার কিছুই করার নেই। ডাক্তার সাহেব ৪৫ জনের সিরিয়াল নিয়েছেন। আর সিরিয়াল না দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’ অযথা প্যাঁচাল পাইরা সময় নষ্ট করতাছেন বলে এক সহকর্মীর সাথে আড্ডা জুড়ে দিলেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মিঠু মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঢামেক হাসপাতালে ভাল চিকিৎসা হয় শুনে স্ত্রীকে দেখাতে এসে যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হলো তা জীবনে ভুলতে পারবো না। ডাক্তার আর্জেন্ট লিখে দেয়ার পরও আলট্রাসনোগ্রাম করাতে পারছি না। হাসপাতালের কর্মচারীরা বলেন, মরে গেলেও তাদের কিছুই করার নেই।
শুধু মিঠুর স্ত্রীই নন, তার মতো আরো অনেক নারী, পুুরুষ ও শিশু ঢামেক হাসপাতালের এক্সরে অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের আলট্রাসনোগ্রাম শাখায় গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রেহানা বেগমের আলট্রাসনোগ্রাম করাতে পারেন নি তার পরিবার। তবে হাসপাতালের এক কর্মচারী আশ্বাস দিয়েছে অপেক্ষা করলে পরে একটা উপায় খুঁজে বের করবে।
অনুসন্ধানে জানা গেল, বহিঃবিভাগ সংলগ্ন এক্সরে বিভাগে আগে ৩টি আলট্রাসনোগ্রাম মেশিনে প্রতিদিন গড়ে দেড়শতাধিক রোগীর বিভিন্ন ধরনের আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা হতো।
কিন্তু বিগত বেশ কিছুদিন ধরে ৩টি মেশিনের দু’টি বিকল থাকায় মাত্র ১টি মেশিনে আলট্রাসনোগ্রাম করা হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
বুধবার সকালে সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে- শিশু থেকে বৃদ্ধ নানা বয়সী রোগী কেউ বেঞ্চে কেউবা ট্রলিতে শুয়ে অপেক্ষা করছেন। ওয়ার্ডবয় রোগীদের বেশি করে পানি পান করে প্রস্রাবের বেগ আসলে তাকে জানাতে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। রোগীদের অনেকেই প্রস্রাবের বেগ এসে ছটফট করতে থাকলেও একটি মাত্র মেশিন সচল থাকায় তারা তাৎক্ষণিক প্রবেশ করতে পারছিলেন না।
সোহেল মিয়া ডেমরা সংলগ্ন কাঁচপুর থেকে স্ত্রী লাইলীকে নিয়ে সকাল ৬টায় বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে হাসপাতালে আসেন। স্ত্রীর লাইলী রক্তপাতজনিত সমস্যায় ভুগছেন জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীর অবস্থা সিরিয়াস, সিরিয়াল পেলেও এখনও ডাক পাননি। কারণ জানতে চাইলে কর্তব্যরত এক কর্মচারী জানান, যে গাইনি ডাক্তার আলট্রাসনোগ্রাম করবেন তিনি দেরিতে এসেছেন।
সোহেল মিয়া জানান, তিনি দু’দিন আগে স্ত্রীর আলট্রাসনোগ্রাম করিয়েছিলেন। কিন্তু ঢামেকের ডাক্তার নতুন করে আলট্রাসনোগ্রাম করাতে বলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, কিছুদিন পরপর আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। তবে এগুলো সত্যি বিকল নাকি বিকল করে ফেলে রাখা হয় তা খতিয়ে দেয়া উচিত।
এ বিষয়ে ঢামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. নাজিমুন্নেসা বলেন, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন একটি আছে একথা ঠিক। তবে মুমূর্ষু কোনো রোগীকে ফেরত দেয়ার কথা না। ৩টার পরে আসতে বলার কথাও ঠিক না। এ বিষয়টি খোঁজ নেবেন বলে জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে নতুন আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
এমইউ/এসএইচএস/এআরএস/পিআর