শিক্ষক যখন কুলি


প্রকাশিত: ১২:৫১ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০১৫

দুপুর আনুমানিক দেড়টা। বকশিবাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। দুই হাতে তাঁর ভারি দুটি বস্তা। মিনিট দশেক রিকশাওয়ালাকে ডাকাডাকি করলেন, কিন্তু ভাড়া বেশি চাওয়ায় রিকশায় উঠলেন না। এক পর্যায়ে একটি বস্তা মাথায় ও আরেকটি বস্তা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।

বদরুননেসা স্কুলের সামনে পর্যন্ত এসে হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। মাথা থেকে বোঝা নামিয়ে দু’ হাত দিয়ে বস্তা দুটিকে ধরে দাঁড়ান। তখন শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছিল। ভদ্রলোকের নাম বারি ভুঁইয়া। পেশায় একজন শিক্ষক।

গত ২৬ বছর যাবৎ টাঙ্গাইলের ধরেরবাড়ি হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। সোমবার কাক ডাকা ভোরে বোর্ড অফিসে জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার খাতা সংগ্রহের জন্য এসেছেন। কয়েকঘণ্টা অপেক্ষার পর খাতা বুঝে পেয়েছেন।

এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে লজ্জায় হেসে বললেন, বয়স হয়েছে। আগের মতো পরিশ্রম করতে পারি না। রিকশাওয়ালা তিনগুণ ভাড়া চাইলো। তাই এ পথটুকু হেঁটে আসলাম আর কি!

teacher
তিনি জানান, প্রিন্সিপালের আদেশে পরীক্ষার খাতা নিতে এসেছেন। সকালে বোর্ড অফিসে আসার পর থেকে শিক্ষকদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে দেখছেন। আমাদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হলেও বোর্ড অফিসের পিয়নরাও সম্মান করে কথা বলে না। খাতা বুঝে নেয়ার পর গেট থেকে বের হওয়া পর্যন্ত কয়েকজনের প্রতিজনকে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বকশিস দিতে হয়েছে। গেটের বাইরে এসে দেখি রিকশা নেই। তাই নিরুপায় হয়ে নিজেই কুলি হয়ে বোঝা মাথায় ওঠাতে বাধ্য হয়েছি।

৪শ শিক্ষার্থীর পরীক্ষার খাতা নিয়ে বাড়ি পৌঁছা না পর্যন্ত দুঃশ্চিন্তায় থাকি। রাস্তায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে মনের মধ্যে খাতা হারানোর ভয় কাজ করে।

তিনি বলেন, পরীক্ষার্থীর খাতাগুলো জেলাওয়ারি বণ্টনের সুব্যবস্থা করা হলে শিক্ষকদের ভোগান্তি বহুলাংশে কমতো।

পরীক্ষার খাতা সংগ্রহ করতে এসে আজ চরম ভোগান্তির শিকার শুধু টাঙ্গাইলের শিক্ষক বারি ভুঁইয়া একা নন, নারী পুরুষ নির্বিশেষে তার মতো শত শত শিক্ষককে তা পোহাতে হয়।

teacher
শিক্ষকরা জানান, পরীক্ষার খাতা দেখে তাদের আগামী ২৬ নভেম্বরের মধ্যে জমা দিতে বোর্ড থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ দিন দুপুরে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড অফিসে গিয়ে দেখা যায় শত শত শিক্ষক জেএসসি খাতার বস্তা নিয়ে বোর্ড অফিসের ভেতরে ও গেটের সামনে অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ ভারি বস্তা ওঠাতে না পেরে সামান্য পথটুকু পেরোতে কুলি ঠিক করেছেন। কিন্তু, গেটের সামনে বস্তা নামিয়ে ২০০/৩০০ টাকা বখশিস হাঁকছে অনেকে। কম টাকা দেয়ায় কেউ কেউ শিক্ষকদের সাথে খারাপ ব্যবহারও করছেন।

আবদুল মান্নান, ময়মনসিংহ ত্রিশাল থানাধীন গুজিয়া আমিরাবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জানান, বোর্ডের চিঠি পেয়ে খাতা নিতে এসেছেন। চারশ খাতা বুঝে পেয়ে বোর্ডের দেয়া স্বীকৃতিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন।

teacher
তিনি জানান, প্রতি খাতা দেখা বাবদ বোর্ড থেকে মাত্র ১২ টাকা করে পান। তিনি বলেন, পরীক্ষার খাতাগুলো বুঝে পাওয়ার পর থেকে মনের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। কারণ কোনো কারণে খাতাগুলো হারিয়ে গেলে নানা কৈয়িফত ও জবাবদিহি করতে হবে। তাছাড়া খাতাগুলোর সাথে কোমলমতি শিশুদের ভাগ্য জড়িত। খাতাগুলো এভাবে না দিয়ে জেলা ও উপজেলায় পাঠিয়ে দিলে তাদের দুঃশ্চিন্তা দূর হতো।

নরসিংদীর রায়পুরার দৌলতকান্দি এমবি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক স্বপন কুমার বণিক জানান, বোর্ড থেকে তাদের অ্যাপয়েনমেন্ট দেয়া হয়। অ্যাপয়েনমেন্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে স্বীকৃতিপত্র ফরম পূরণ করে খাতা বুঝে নিতে হয়।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ঢাকায় খাতা নিতে আসলে তারা সব সময় আতঙ্কে ভোগেন। পথে প্রসাবের বেগ আসলেও কারও হাতে বিশ্বাস করে খাতা দিয়ে যেতে পারেন না। তাছাড়া বোর্ডের কর্মচারীরা বকশিসের নামে টাকা দাবি করে, না পেলে আপত্তিকর কথাবার্তা বলে থাকে। এত বছর চাকরির পর এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে খুব খারাপ লাগে বলে জানান তিনি।

তেজগাঁও সিভিল এভিয়েশন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রওশন আরা বলেন, যারা ঢাকায় শিক্ষকতা করেন তাদের জন্য খুব কষ্টকর না হলেও ঢাকার বাইরের শিক্ষকদের জন্য খাতা বহন করে নিয়ে যাওয়া সত্যিই কষ্টকর বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ ব্যাপারে জানতে ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দফতরে গেলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা লিখিতভাবে প্রশ্ন দিয়ে পরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।

এমইউ/এসকেডি/এসএইচএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।