রামুর হারানো ঐতিহ্যের স্থানে মাথা তুলেছে সুরম্য অট্টালিকা
আজ ২৯ সেপ্টেম্বর। রামু সহিংসতার তিন বছর। সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিনষ্টের ভয়াল এ রাতের বিভীষিকা মুছে দিয়েছিল শত বছরের ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেহে সৃষ্টি হয়েছিল অবিশ্বাসের বিশাল ক্ষত। এ ঘটনা দিয়ে শত বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফাটল ধরে। তবে, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে ইতোমধ্যে সেই চিড় ধরা ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আবারো জোড়া লাগা শুরু হয়েছে। হারানো ঐতিহ্যের স্থানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সুরম্য অট্টালিকা।
অন্যদিকে তিন বছরের মাথায় এসেও মামলার চার্জশিট দাখিল নিয়ে রয়েছে চরম অসন্তোষ। বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ বলছেন, দেশে-বিদেশে তোলপাড় হওয়া এ ঘটনায় শীর্ষ অভিযুক্তরা বাদ পড়লেও অসংখ্য নিরীহ লোকজন মামলায় জড়িয়ে প্রতিমাসে আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন এখনো। এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে তাদের।
বুদ্ধমুর্তি, বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ সাম্প্রদায়িক হামলার তৃতীয় বর্ষ অতিক্রান্তে সেই বিভীষিকাময় অভিশপ্ত দিনটিকে স্মরণ, মানবতা ও শান্তি কামনায় দিনব্যাপি কর্মসূচি পালন করবে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়। রামু লালচিং-মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্স প্রাঙ্গনে দিনব্যাপি স্মরণায়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার দ্বাদশ সংঘরাজ, বাংলাদেশের বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ড. ধর্মসেন মহাথের। রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য আয়োজনে পুজনীয় ভিক্ষুসংঘ ও দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা অংশ নেবেন বলে জানায়, আয়োজক রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ সভাপতি রজত বড়ুয়া রিকু।
রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজ উল আলম বলেন, রামু সহিংসতার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার তাহা শক্ত হাতে মোকাবেলা করেছেন। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সহিংস ঘটনার পর শেখ হাসিনার সরকার রামুর পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধ মন্দিরগুলোকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দনভাবে গড়ে তুলেছেন। সে সঙ্গে রামুর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষনিক দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, ২০১২ সালে যারা রামুর ইতিহাস, ঐতিহ্য ধ্বংস করতে চেয়েছিল তারা আজ ঘৃণিত, আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার এখন নতুনভাবে রামুর পুড়ে যাওয়া বৌদ্ধ মন্দির গুলোকে সাঁজিয়েছেন। এখন দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান রামু।
জানা যায়, এ ঘটনার পর কক্সবাজারের চারটি উপজেলায় ১৯টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা দায়েরকালীন এসব মামলায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামি দেখানো হয়। এজাহারে নাম উলেখ করা হয়েছে ৩৭৫ জনের। এর মধ্যে শুধুমাত্র রামু উপজেলার ঘটনায় মামলা ছিল আটটি। কক্সবাজার সদর থানায় দুটি, টেকনাফ থানা দুটি, উখিয়া থানায় ৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ঘটনার তিনবছরের মধ্যে এ ১৯টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ।
আদালত সূত্র জানা যায়, এ ১৯ মামলায় চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে ৯৪৫ জনকে। এর মধ্যে রামু উপজেলার আট মামলায় অভিযুক্ত হলেন ৪৫৮ জন।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির রামু উপজেলা সভাপতি স্বপন বড়ুয়া জানান, ঘটনার তিন বছরের মধ্যে বৌদ্ধরা নিরাপত্তায় রয়েছে। কিন্তু মামলার প্রক্রিয়াটি আরো যাচাই বাছাই জরুরি। এতে যে সব নিরীহ লোক হয়রানি হচ্ছেন তাদের বাদ দিয়ে প্রকৃতদের আসামি করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি এ ঘটনার বিচার না হলে অপরাধিরা উৎসাহী হবে।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি (যুব) এর সভাপতি সুরেশ বড়ুয়া জানান, ঘটনার অনেক ছবি ও ভিডিও রয়েছে। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তও হয়েছে। এতে চিহ্নিতদের অনেকেই মামলায় আসামি নন। আবার এমন অনেক ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানো হয়েছে যারা কোনোভাবেই এ ঘটনায় জড়িত নন। ফলে বিষয়টি জটিল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, নতুনরূপে সেজেছে রামুর বৌদ্ধপল্লী। বদলে গেছে সবকিছু। ইতিহাসের জঘন্য বর্বর ধ্বংসযজ্ঞের কিছুই আর চোখে পড়ে না। ক্ষতিগ্রস্ত বিহারের ধ্বংস্তুপের মাঝেই তৈরি হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে দৃষ্টি নন্দন বৌদ্ধ বিহার। দর্শণার্থীদের পদচারণায় এখন মুখর হয়ে উঠেছে অপরূপ সজ্জিত রামুর বৌদ্ধ বিহারগুলো। ২৯ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার পর পোড়ামাটিতে ১০ মাসে পূনঃনির্মিত হয়েছে ১২টি বৌদ্ধ বিহার। দৃষ্টিনন্দন ঝলমল এসব বিহার রামুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি রামুর দীর্ঘদিনের পূরাকীর্তি আর নানন্দনিক সৌন্দর্যে নতুনমাত্রা এনে দিয়েছে।
২৯ সেপ্টেম্বর রাতে দূর্বৃত্তদের দেয়া আগুণে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস হলেও সেই ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন এখন আর নেই। সেই ধ্বংসস্তুপের উপর ১০ মাসের মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এসব বিহার। বিহারগুলোর পূনঃনির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে পাল্টে গেছে রামুর দৃশ্যপট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিহার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। মুছে গেছে ২৯ সেপ্টেম্বর ভয়াল কালো রাতের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার ঘুরে দেখা যায়, এখানেও উঠেছে তিনতলা সুরম্য ভবন । ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি বিহারের মধ্যে সবচে বেশি টাকা ব্যায় করা হয়েছে এই বিহারে । এছাড়াও শ্রীকুল গ্রামের লাল চিং, সাদা চিং, অপর্ণা চরণ চিং এবং মৈত্রী বিহারের চেহেরাও পাল্টে গেছে। সাদা চিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। পাশের মৈত্রী বিহার এবং অপর্ণাচরণ চিংসহ একইস্থানে পাশাপাশি চারটি বিহারে এই কম্পাউনটিও অসাধারণ লাগছে।
রামু মৈত্রী বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ বড়ুয়া জানান, রামু সহিংসতার পর রাত-দিন পরিশ্রম করে সেনাবাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলোর নির্মাণ কাজ করেছে। তবে হামলার ঘটনার সঠিক বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকেই যায়।
স্থানীয় শিক্ষাবীদ নিলুৎপল বড়ুয়া জানান, আমরা চাই যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পল্লী ও বিহার পুনঃর্নিমাণ হয়েছে-সেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আগের মতো নির্মিত হোক। আমরা আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাই। এটা আমরা প্রত্যাশা করছি যে, আগের মতো মিলেমিশে থাকবো। কোনো রকম ভেদাভেদ থাকবে না। প্রতিশোধমূলক কোনো রকম বিষয় থাকবে না আমাদের মনে।
কেন্দ্রীয় সীমা বৌদ্ধ বিহারের সহকারী অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানিয়েছেন, সরকারি উদ্যোগে দেশবাসীর সহযোগিতায় পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বিহার নির্মাণ করা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ যোগ্য।
উল্লেখ্য, রামুর উত্তম বড়ুয়া নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী রামুর বারটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার ও ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করে।
এ সময় অরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার ও শতাধিক বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পরদিন উখিয়া-টেকনাফে আরো কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে একই ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত বিহার পূননির্মাণের কাজ শুরু করে।
সায়ীদ আলমগীর/বিএ