প্রিয় নেত্রীর হাতে আর হাত রাখা হয়নি তার
বক্তব্য শেষে প্রিয় নেত্রীকে মঞ্চ থেকে নামাবেন বলে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘক্ষণ। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তব্য শেষ করেছেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে হাত ধরে নামাতে নিজের হাত বাড়িয়ে রেখেছেন আগে থেকেই। কিন্তু শেষ বেলায় হাতে আর হাত রাখার সুযোগ দিলো না ঘাতকরা। মুহূর্তেই যেন রক্তপিণ্ডে রূপ নেয়। মাটিতে লুটে পড়েন আইভি রহমান।
আজ আইভি রহমানের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহামান। তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জীবনযুদ্ধে হেরে যান সংগ্রামী এই নারীনেত্রী।
ওইদিন একেবারে মঞ্চের কাছে অবস্থান করছিলেন আইভি রহমান। আচমকা গ্রেনেড হামলায় সমাবেশের সমস্ত চিত্র যেন পাল্টে যায়। ওইদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আইভি রহমানের দুটি পা-ই গ্রেনেডের আঘাতে ছিটকে যায়।
প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আইভি রহমানকে। হাসপাতালের বিছানায় দীর্ঘ ৫৭ ঘণ্টা লড়ে মৃত্যুও কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
তার পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি। জন্ম ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর। কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানায়। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এসেছিলেন রাজনীতিতে। তারপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের স্বার্থে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ মরহুম জালাল উদ্দিন আহমদ আর হাসিনা বানুর সন্তান আইভি। আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তার অবস্থান ছিল পঞ্চম। লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় পরিবারেই। ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই আইভির বিয়ে হয়ে যায় ভাষা আন্দোলনের তুখোড় নেতা এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। বিয়ের পর তার নাম হয় আইভি রহমান। বিয়ের পরেও থেমে থাকেনি লেখাপড়া। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ভৈরবে স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই বাংলায় অনার্স সম্পন্ন করেন তিনি।
ছাত্র জীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন এই সাহসী নারী। ১৯৬২ সালে আইয়ুব সরকারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একজন সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন আইভি রহমান। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এই নারীনেত্রী। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি একজন নেতা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আইভি রহমান বীরোচিত ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি রাইফেল ও ফাস্ট-এইড ট্রেনিং নেন। অন্যান্য মহিলা কর্মীদের সংগঠিত করে ট্রেনিং দেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ নারীবর্ষ উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। তিনি ছিলেন এর একজন উদ্যোক্তা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করার পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যায়। এ সময় তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮ সালে আইভি রহমানকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। দক্ষতার বিচারে ১৯৮০ সালে তাকে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়।
নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সময়কালে তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোধী আইন প্রণয়নে আইভি রহমান অনবদ্য অবদান রাখেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃকিত সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিলেন প্রিয়ভাজন আর আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর শেখ হাসিনার ছিলেন ছিলেন বিশ্বস্ত সহকর্মী। ছিলেন জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত দলের জন্য নিবেদিত।
মুক্তিযুদ্ধ এবং সমাজসেবার ক্ষেত্রে অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য সংগ্রামী নারীনেত্রী আইভি রহমানকে ২০০৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।
আওয়াম লীগ নেত্রী আইভি রহমানের ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়াম লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগ আজ দিনব্যাপি বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এএসএস/বিএ