বিদেশ গিয়ে নিখোঁজ মেহেরপুরের অর্ধশত যুবক


প্রকাশিত: ০৮:০০ এএম, ৩০ মে ২০১৫
ফাইল ছবি

মেহেরপুরের মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে শতাধিক পরিবার। এদের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত অর্ধশত মানুষ। মারা গেছে বলে খবর প্রচার হয়েছে ৪ জনের। তারা হলেন, গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের মামুন (২৫), সদর উপজেলার পাটকেলপোতা গ্রামের আলামিন হোসেন (৩২), সিংহাটি গ্রামের আতিয়ার রহমান (৩৮) ও ঝাঁঝাঁ গ্রামের আনারুল ইসলাম (৪০)।

সম্প্রতি থাইল্যান্ডসহ সাগর থেকে বাংলাদেশি উদ্ধারের খবরে নিখোঁজদের পরিবারে নিখোঁজ ব্যক্তিকে ফিরে পাওয়ার আশা জাগলেও শোকের মাতম চলছে মৃত্যু খবর পাওয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। কম খরচে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে পানি পথে থাইল্যান্ডের পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দেয়া হয় এসব সাধারণ মানুষগুলোকে। স্থানীয় দালালরা এদের নিয়ে যান টেকনাফ। সেখান থেকে তুলে দেয়া হয় সাগরের পানি পথে ট্রলারে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাত্র পঞ্চাশ হাজার বা এক লাখ টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে কাজ করে বাকি টাকা পরিশোধ করলেই হবে। এমন প্রলোভনে পড়ে মেহেরপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ দালালদের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। ১০-১৫ বা ২০ দিন পর মোবাইল ফোনে খবর আসে তারা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের হাতে আটকা পড়েছেন। ২ বা আড়াই লাখ টাকা দিলে মালয়েশিয়া পৌঁছতে পারবেন। বাড়ির লোকেরা হয় ধার-দেনা করে নয়তো সহায় সম্বল বিক্রি করে দালালদের হাতে টাকা তুলে দেন। টাকা পৌঁছনোর আগ পর্যন্ত চলে শারীরিক নির্যাতন। আর তিন বেলার মধ্যে খাবার দেয়া একবার। সেটিও আবার পরিমাণে সামান্য। কোনো কিছুর ব্যাঘাত ঘটলেই বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। অসুস্থ হয়ে মারা গেলে সাগরের পানিতে অথবা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেয়া হয় মরদেহ। আবার কখনো মাটি চাপা দেয়া হয়। টাকা দিতে না পারলে নিশ্চিত মৃত্যু।

টাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসা কয়েকজনের কাছ থেকে জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় পাচারকারী চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রামের আব্দুল গনির ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন, হেমায়েতপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন, খড়মপুর গ্রামের আলি হোসেন, কসবা গ্রামের বদর উদ্দিনের ছেলে আব্বাস আলী, সদর উপজেলার শিংহাটি গ্রামের ইমারুল, মোশারফের ছেলে সাজিবুল, ইছাখালি গ্রামের মৃত সুরমান আলীর ছেলে সাদের আলী, আব্দুস সাত্তারের ছেলে সিদ্দিক এবং শিংহাটি গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমাদুল।

তবে ছুটিতে বাড়ি আসা ইমাদুল জাগো নিউজকে জানান, তিনি কোনো লোক পাঠানোর কাজ করেন না। তাদের এলাকার তিন-চারজন ছেলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে দালালদের কাছে আটকা পড়লে তাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন পরিবারের লোকজন। বিপদের কথা বিবেচনা করে তিনি তাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া ফার্মে কাজ করা কয়েকজন বার্মার লোকের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অবস্থান করা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। দালালদের দাবি করা টাকা তাদের দেয়া লাইলী ও এমআর ট্রেডার্সের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়েছে। তিন জনের জন্য সাড়ে ছয় লাখ টাকা তার শ্যালক রিপনের কাছে দিলে তিনি চুয়াডাঙ্গা ইসলামী ব্যাংক থেকে তাদের ওই অ্যাকাউন্টে পাঠান। রিপন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভায় কনসালটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন। তবে দালালদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে রয়েছেন।

যেসব মানুষগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের টেকনাফে নিয়ে প্রথমে লাইলী, মঞ্জু ও আসলামের বাড়িতে রাখা হয়। বাড়িগুলো পলিথিনে ছাওয়া এবং বেড়া দিয়ে ঘেরা। এক একটি বাড়িতে ৫০-৬০ জনকে জড়ো করা হয়। এরপর একসঙ্গে রাতের আঁধারে ট্রলারে তোলা হয়। এক একটি ট্রলার তিন থেকে চারশ লোক নিয়ে যায়। ট্রলারে তোলার আগে সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন, ঘড়ি, টাকা-পয়সা সব কেড়ে নেয়া হয়।

টেকনাফের ওই সব বাড়িতে ঢুকলে আর বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ থাকে না। সব সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পাহাড়া দেন। ট্রলারে করে থাইল্যান্ডের পাহাড়ের উপরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিয়ে যায় থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া সীমান্তে। যেখানে সব সময় তিন চার হাজার করে লোক থাকেন। সবখানেই অস্ত্রধারী লোকজন পাহাড়ায় থাকে। সীমান্ত এলাকার পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে আটকে রেখে বাড়িতে ফোন করিয়ে টাকা পাঠাতে বলা হয়।  

টাকা পেলে মালয়েশিয়া ঢোকার জন্য কালো ত্রিপলে ঢাকা ছোট ছোট পিকআপে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় অনেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আবার কেউ কেউ অবৈধভাবে ঢুকে পড়েন মালয়েশিয়া।  

এমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।