মাটি ছাড়াই ফসল আবাদ!
এই পৃথিবীর তিনভাগ জল আর মাত্র এক ভাগ স্থল বা ভূমি। এই একভাগ স্থলেই ৬৫০ কোটির বেশি মানুষের আবাস, আবাদসহ যাবতীয় কার্যক্রম। কিন্তু বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা নিবারণে এক ভাগ স্থল আদৌ যথেষ্ট নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ কঠিন সত্যটি উপলদ্ধি করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। কীভাবে সীমিত জমির উত্তম ব্যবহার করে ফসলের ফলন বাড়ানো যায় তা নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে ব্যাপক বিস্তর গবেষণা।
এই গবেষণায় সফলতা নেহায়েৎ কম নয়। ব্যাপক গবেষণার ফলাফল স্বরূপ পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ আজও পেটপুরে খেতে পারে। যদিও এখনো খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে আছে শতকোটির বেশি মানুষ, যারা একবেলাও পেটপুরে খেতে পায় না। এ সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন এমন একটি আধুনিক ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি যেখানে চাষাবাদে প্রয়োজন হবে না ভূমি বা মাটির।
ভাবছেন মাটি ছাড়া ফসল আবাদ কীভাবে সম্ভব, হ্যাঁ হাইড্রোপনিক এমনই একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। হাইড্রোপনিক পদ্ধতি হলো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানিতে গাছের খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে শস্য উৎপাদনের একটি কৌশল। বাংলাদেশ জনবহুল একটি দেশ এবং প্রতি বছরই আবাদী জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশসমূহের মতো আমরাও হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করে বছরব্যাপী বিভিন্ন শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটাতে পারবো।
এ পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব এবং উৎপাদিত ফসলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। জনবহুল এদেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম কিংবা সীমিত, সেখানে ঘরের ছাদে বা আঙিনায়, পলি টানেল, কিংবা নেট হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব।
ইতোমধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সারাবছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা মাটি ছাড়াই হাইড্রোপনিকের মাধ্যমে সবজি, ফুল ও ফল চাষে সফল হয়েছেন।
এভাবে সারাবছর পানিতে নিমজ্জিত থাকে এমন এলাকা বা বাড়ির বারান্দা, ছাদ ও উঠানে অধিক শস্য চাষাবাদ করে পারিবারিক চাহিদার অনেকাংশই পূরণ করা সম্ভব। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বারির কৃষি বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত টমেটো, বেগুন, শশা, মরিচ, শিম, খিরা, লেটুস পাতা, ক্যাপসিকাম, গাঁদা ফুল, চন্দ্রমল্লিকা, ফুলকপি, বাঁধা কপি, স্ট্রবেরি, অর্কিড ও ব্রোকলির মতো বেশকিছু ফসলের চাষ করে সফলতা পেয়েছেন।
সাধারণত দু`টি উপায়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। ১. সঞ্চালন পদ্ধতি এবং ২. সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
সঞ্চালন পদ্ধতি : সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি বড় পাত্র বা টাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধতি গ্যালভানাইজিং লোহার তৈরি ট্রে একটি স্ট্যান্ডের ওপর স্থাপন করে প্লাস্টিক পাইপের সাহায্যে একটি ট্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ট্যাংক থেকে পাম্পের সাহায্যে রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত জলীয় দ্রবণ ট্রেতে সঞ্চালন করা হয়। ট্রের ওপর কর্কশিটের মধ্যে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা স্পঞ্জসহ ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। চারা রোপণের পর ট্যাংক থেকে ট্রের মধ্যে জলীয় দ্রবণ পাম্পের সাহায্যে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা সঞ্চালিত করে গাছের অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। ট্রেতে কমপক্ষে ৬-৮ সেমি পানি সব সময় রাখতে হবে। সাধারণত প্রতি ১২-১৫ দিন অন্তর জলীয় দ্রবণ ট্রেতে যোগ করতে হবে।
সাধারণত হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে উৎপাদনের জন্য পিএইচ মান ৫.৮-৬.৫ এর মধ্যে রাখতে হয়। যদি পিএইচ-এর মান ৭ এর ওপরে হয় তবে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনামসহ অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। এ অবস্থায় হাইড্রোক্লোরিক এসিড বা ফসফরিক এসিড দিতে হয়। আবার পিএইচ-এর মান ৫.৮ এর নিচে হলে তখন সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড প্রয়োগ করে পিএইচ-এর মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি : সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদনসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। তবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। ফসলের প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করা হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদে বা খোলা জায়গায় সহজেই সবজি উৎপাদন করতে পারেন।
এ পদ্ধতিতে ট্রে, প্লাস্টিকের বালতি, বোতল ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা হয়। চারা রোপণের আগে বোতল জলীয় দ্রবণ দ্বারা এমনভাবে পূর্ণ করতে হবে, যাতে কর্কশিট ও জলীয় দ্রবণের মধ্যে ৫-৮ সেমি ফাঁকা জায়গা থাকে। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে। সাধারণত দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন :
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত স্পঞ্জকে ৩০ সেমি/৩০ সেমি সাইজে কেটে নিয়ে এটিকে ২.৫ সেমি দৈর্ঘ্য এবং ২.৫ সেমি প্রস্থ বর্গাকারে ডট করে কেটে নিতে হয় এবং প্রতিটি বর্গাকার স্পঞ্জের মধ্যে ১টি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে বীজকে ১০ শতাংশ ক্যালসিয়াম অথবা সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ বপনের পর স্পঞ্জকে ১টি ছোট ট্রেতে রাখতে হবে। এ ট্রের মধ্যে ৫-৮ সেমি পানি রাখতে হবে, যাতে স্পঞ্জটি পানিতে সহজে ভাসতে পারে। চারা গজানোর ২-৩ দিন পর প্রাথমিক অবস্থায় ৫-১০ মিমি খাদ্য উপাদান সংবলিত দ্রবণ ১বার এবং চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর থেকে চারা রোপণের আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ১০-২০ মিলি দ্রবণ দিতে হবে।
রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ও মিশ্রন তৈরির পদ্ধতি :
জলীয় খাদ্য দ্রবণ তৈরিতে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির জন্য পটাশিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাশিয়াম ও নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট ১ হাজার গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রন ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম, কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম, অ্যামোনিয়াম মলিবডেট ০.৩৮ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম। খাদ্য উপাদান মিশ্রিত করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
প্রথমে স্টক সলিউশন তৈরি করতে হবে। এ ঝঃড়পশ তৈরি করার সময় ক্যালসিয়াম নাইট্রেট এবং ইডিটিএ আয়রনকে পরিমাপ করে ১০ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে দ্রবণকে স্টক সলিউশন-এক নামে নামকরণ করতে হবে। অবশিষ্ট রাসায়নিক দ্রব্যগুলোকেও একসঙ্গে ১০লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে স্টক সলিউশন-দুই নামকরণ করতে হবে। ১ হাজার লিটার জলীয় দ্রবণের জন্য ১ হাজার লিটার পানি ট্যাংকে নিতে হবে।
তারপর স্টক সলিউশন-এক থেকে ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকের পানিতে ঢালতে হবে এবং কাঠির সাহায্যে নাড়াচাড়া করে ভালোভাবে মেশাতে হবে। এর পর স্টক সলিউশন-দুই থেকে আগের মতো ১০ লিটার দ্রবণ ট্যাংকে নিতে হবে এবং ভালোভাবে মেশাতে হবে।
লেখক : কৃষিবিদ, এম আব্দুল মোমিন, সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার, ব্রি, গাজীপুর।
বিএ/আরআই