আমি সেনা পরিবারের নই। সেনাবাহিনীতে আমার আসা সিভিল পরিবার থেকে। এসেছিলাম লাল শাড়ি পরে। পিলখানা থেকে বের হয়েছিলাম সাদা শাড়ি পরে, বিধবা হয়ে। সেদিন আমি কাউকে পাইনি। শুধু সাংবাদিকদের দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে পিলখানা থেকে বের হয়েছিলেন।
Advertisement
কথাগুলো শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফের স্ত্রীর। রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির নির্মম হত্যাযজ্ঞের এভাবেই স্মৃতিচারণা করেন তিনি।
শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফের স্ত্রী বলেন, ‘সেদিন সকালে গুলির শব্দ শোনার পর সাইফকে (স্বামী) ফোন করে বললাম কী হচ্ছে? বললো এখানে গন্ডগোল হচ্ছে। বললাম সেক্টর কমান্ডারের বাসায় আগুন জ্বলছে। একটু পর আমার বাসায় সৈনিকরা আসে। দরজায় ধাক্কায়। সতর্ক করে সকাল ১০টায় ফোন করে সাইফ বলেছিল, তোমরা ভাল থেকো, সাবধানে থেকো।’
‘এরপর ছোট ছেলেকে ডেকে ফোনে কথা বলে সাইফ। বলে- বাবা তুমি ভালো থেকো, তোমার মাকে দেখে রেখো। বাইরে যেন না যায়। এরপর শুধু বলে র্যাবকে বলছি, ক্যান্টনমেন্টে ফোন করছি, ওরা গাড়ি পাঠাবে। তোমরা চলে যেও। এরপর একাধিকবার ফোন করছি, এই যাচ্ছে, এই আসছে। কিন্তু গাড়ি আর আসেনি। এদিকে সারাদিন সৈনিকরা দরজায় ধাক্কায়, দরজা ভাঙে- নানান কিছু।’
Advertisement
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফের স্ত্রী আরও বলেন, ‘দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১০ জন লোক ৫টা অস্ত্র তাক করে ধরে মাথায়। আমি ভয়ে ওয়্যারড্রপ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ি। আমার ছোট ছেলে ওদের পা জড়িয়ে ধরে বলে- আঙ্কেল, আমার মাকে কিছু বইলেন না, আমার আব্বুকে যা বলার বলেন। তখন আমি দোয়া করি- আল্লাহ আমার ছেলেকে ভিক্ষা দাও।’
‘সেদিন শুধু সাংবাদিক ভাইদের দেখেছি। তারাই আমাদের নিয়ে বের করেছেন। সাংবাদিকরা বলছিলেন- আমরা মরবো কিন্তু এদের না নিয়ে যাবো না।’
আক্ষেপ করে শহীদ সাইফের স্ত্রী বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনীতে আসছিলাম সিভিল পরিবার থেকে। লাল শাড়ি পরে আসছিলাম। আর আমি সাদা শাড়ি পরে বের হয়েছি। আমার ভাইদের মরদেহ, সন্তানদের বাবাদের মরদেহের মাথায় হাত বুলিয়েছে আমার বড় ছেলে। বাবার মরদেহ খুঁজে বের করতে হয়েছে বড় ছেলেকে। এক অফিসার ফোন করে জানান, সাইফ স্যারকে পাওয়া গেছে। ওই ভাই আমাদের নিয়ে যাবার পর সাইফকে নামানো হলো। সাইফের চেহারাটা দেখেছি, মুখটা দেখেছি, পেটে দেখি ৪টা গুলির চিহ্ন। যে সাইফকে আমি সকালে নাস্তা করিয়েছি, সেই সাইফকে চিনতে পারিনি। চারটা গুলি, পেটে চারটা গুলি দেখে আমি ফিরে এসেছি, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘আজ আমি কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আসিনি। আজ শুধু আমার বুকের পাথরটা সরিয়ে এসেছি। আজ ৫৭টা বোন নিয়ে আসছি। বিধবার শাড়ি পরা এই বোনটার জন্য শুধু দোয়া করবেন। কোথায় থেকে আমি বেঁচে ফিরেছিলাম। এখনো গোলাগুলি হলেই ভয় পাই, আঁতকে উঠি। যেটা সত্যি, যেটা ন্যায় সেটাই আপনারা সমর্থন দিন।’
Advertisement
ইতিহাসের সেই ভয়াল ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) রিয়াজ বলেন, ‘সেদিন যারা পিলখানায় ছিলেন, বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারাই জানেন সত্যিটা কী। অথচ যারা সেদিন ভেতরে ছিলেন না, বাইরে ছিলেন তারাই বিভিন্নভাবে বয়ান করছেন, ভিন্নভাবে সেদিনের ঘটনাটা আঁকছেন। অথচ আমরা সেদিনের ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী।’
আরও পড়ুন একে একে কারাগার থেকে বের হচ্ছেন মুক্তি পাওয়া বিডিআর জওয়ানরা বিনা দোষে আমাদের জীবন থেকে ১৬টি বছর চলে গেছেতিনি বলেন, ‘ছোট ছোট দুটি বাচ্চা আর স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে ৩৬ ঘণ্টা আটকে ছিলাম। হেন কোনো অপরাধ নেই যেটা সেদিন সৈনিকরা করেনি। অস্ত্রাগার-গোলাবারুদ লুটের মাধ্যমে অপরাধ শুরু হয়। দরবার হলে সেদিন সৈনিক মঈন যখন পেছনে গিয়ে অস্ত্র তাক করলেন, বিজিবি ডিজি বলেছিলেন সবাই অস্ত্র ফেলে দাও। অফিসাররা কখনো সৈনিকদের গুলি করতে পারে না। সৈনিকরা কী প্রতিদান দিয়েছিলেন? সেই জোয়ানরাই ডিজিকে, পরিবারকে, তার বাসায় আসা অতিথিদের-স্ত্রীকে হত্যা করলেন, এমনকি কাজের মেয়েকেও হত্যা করা হয়। বিপথগামী সৈনিকরা সেদিন ৫৭ সেনা অফিসারকেই শুধু হত্যা করেননি, মরদেহ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করেছিল। মাটিচাপ ও গণকবর দিয়েছিল তারা।’
অবসরপ্রাপ্ত এ সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘সেদিন কেউ বলেছে, ডাল-ভাত ইস্যু। কিন্তু কী অপরাধ ছিল? আমি নিজেও পরবর্তীতে তদন্ত কাজে জড়িত ছিলাম, সেখানে ডাল-ভাতের বিষয়ের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা আমরা পাইনি। তাদের অপরাধ ছিল দেশপ্রেমিক, জীবন বাজি রেখে সীমান্ত পাহারা দিয়েছিল, আপস করেনি। অনুরোধ, সত্যটা তুলে ধরুন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘যাদের জামিন দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করতে চাই না। কিন্তু ঢালাওভাবে সবাইকে ছেড়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমরা।’
পিলখানায় শহীদ মেজর আব্দুস সালামের বড় ছেলে সাকিব মাহমুদ খান বলেন, ‘৩৬ ঘণ্টা জিম্মি ছিলাম। বের হওয়ার পর যখন খবর পেলাম কিছু অজ্ঞাতপরিচয় ও শনাক্তহীন মরদেহের সন্ধান মিলেছে, আমরা বের হয়ে এসে প্রথমে মরদেহ দেখে চিনতে পারিনি। পরে কথা বলে আবার দেখতে যাই, পরে আঙ্কেলরা নানানভাবে পয়েন্টআউট করে জানান ওইটাই আমার বাবার মরদেহ। সেই ছবিটাই এখনো ভেসে ওঠে। আমার বাবার স্মৃতি বলতে ওই ছবিটাই শেষ।’
বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, ‘আমার এখানে উপস্থিতির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে আমি একমাত্র বিডিআর পরিবারের সন্তান। আর এটাই প্রমাণ করে সেদিন সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে বিরোধ ছিল না। আমাদের বিরোধ হত্যাকারী, চক্রান্তকারী, মরদেহ বিকৃত করা নৃসংশকারীদের সঙ্গে।’
তিনি বলেন, ‘অপরিচিত কেউ যদি বিপদে পড়েন এখনো আমরা তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। কিন্তু সেদিন পিলখানায় সাড়ে ৯ হাজারের বেশি বিভিন্ন র্যাংকের বিডিআর সদস্যের উপস্থিতিতে অফিসারদের হত্যা করা হয়। একমাত্র একজন আমার বাবা ছাড়া আর কেউ বাধা দেয়নি। আর এই বাধা দেওয়ার কারণেই আমার বাবাকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়।’
হান্নান বলেন, ‘কেন বাধা দেওয়া হয়নি? কারণ কুশীলব, মাস্টারমাইন্ডদের ট্যাবলেট খেয়ে, চক্রান্তে যুক্ত হওয়ায় প্রতিবাদ করেননি কোনো বিডিআর সদস্য। আজ ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়েছেন। এই ফ্যাসিজমের সফল যাত্রার শুরু কিন্তু পিলখানায়। সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা কিন্তু পালিয়েছেন। তারপর থেকেই আমাদের বিডিআর সদস্যের পরিবাররা বলতে শুরু করলেন পিলখানার সেই ঘটনা যেন শেখ হাসিনা একাই করেছেন। একাই গণকবর, হত্যা, মরদেহ বিকৃত করেছেন, আর কেউ করেনি।’
অনুষ্ঠানে পিলখানায় শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীর সন্তান অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, ‘শহীদ পরিবার ও বেঁচে ফেরা সেনা অফিসাররা আজ বিচার চাইতে আসিনি। স্মৃতিচারণ করতে এসেছি। কতটা নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। যা আজ ন্যারেটিভ তৈরি করে সেটা মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। আজ বাবার খুনিদের যদি আপনি দেখেন আপনার আশপাশেই হেঁটে বেড়াচ্ছে তখন কেমন লাগবে? আপনারা তখনকার ভিডিওগুলো খুঁজে দেখেন, কী নির্মমতা ছিল। আমরা শুধু বলতে চাই, চাইলেই ঢালাওভাবে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না।’
এসময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা, শহীদ কর্নেল মজিবুল হকের স্ত্রী নাহরীন ফেরদৌস, পিলখানায় শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুল আজমের স্ত্রী মুনমুন আক্তারসহ অন্যান্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
টিটি/কেএসআর/জিকেএস