২০১১ এর সেপ্টেম্বরে ঠাকুরগাঁওয়ে একজন সাংসদ রানীশংকৈল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষকে মারধর করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন কাউকে না জানিয়ে তার জমির গাছ কাটায় তিনি উত্তেজিত হয়ে শিক্ষককে পিটিয়েছেন।২০১৩ সালের জুলাই মাসে সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে ঢুকে ডেপুটেশনে থাকা স্কুল শিক্ষককে মারধর করেছেন স্থানীয় সাংসদ। ময়মনসিংহের একজন সাংসদের নির্দেশে এক কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছিল। এরপর তারই নির্দেশে এক শিশুকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হলো।২০১৫ সালে আর সিলেটের একজন সংসদ সদস্য অধ্যাপক জাফর ইকবালকে কোর্ট পয়েন্টে ধরে এনে চাবুক মারার খায়েস করেছিলেন। শিক্ষকদের এমন মারধরের ঘটনা এদেশে নতুন নয়। গত কয়েক বছরে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। কোথাও আমরা তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। প্রতিক্রিয়াও দেখিনি। প্রতিরোধের কথাতো ভাবাই যায় না। এই মুহূর্তে নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুল শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করার ঘটনার প্রতিক্রিয়াও দেখছি শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কই, কোথাওতে তেমন কোন নড়চর দেখছিনা। রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, নানা পেশাজীবী সংগঠন কতো শত সংগঠন কাউকেই দেখিনি একটি শ্লোগান দিতে, ন্যূনতম প্রতিবাদ জানাতে। আর আমাদের শিক্ষকরা? বেতন আমলাদের চেয়ে কম হল কিনা, মর্যাদায় আমলাদের চেয় কম হলো না কিনা এ নিয়ে মিছিল সমাবেশ, কর্মবিরতি কি ই না করেছেন। কিন্তু চড় থাপ্পড় খাওয়া, কানে ধরে ওঠাবসা করলে তাদের মর্যাদা নষ্ট হয় না। আমার আরো দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও রাজনৈতিক কর্মীরা মারধর করেছেন। তখনও তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি । গণমাধ্যমে ওই শিক্ষককে কানে ধরে ওঠাবসা করার দৃশ্য যারাই দেখেছেন তারা সবাই লজ্জিতবোধ করেছেন বোধ করি। গণমাধ্যমের কেমন যেন আমাদের মতোই ভোতা অনুভূতি। কী করে শিক্ষকের মুখখানি না ঢেকে ওই দৃশ্য দেখালো! সহ্য করার মতো নয়। কিন্তু আমরা সবাই সহ্য করে চলেছি। আমাদের অনুভূতি আসলেই স্পর্শকাতর নয়। আমাদের বিবেক যা অবশিষ্ট ছিল তাও নেই। আমরা উল্লাস করি, আমরা সিটি বাজাই। আমরা টকশোতে কথা বলি না। আমরা এমন অপমানিত হই বারবার, অপমান চেয়েছিলাম। আমরা এমন ছাত্র নই যারা শিক্ষককে অপমান করলে নিজেরা অপমানিত হই। আমরা অমন শিক্ষক নই যারা সহকর্মীর অপমানকে নিজেদের অপমান বলে মনে করি। আমরা অমন আইন প্রণেতা নই যারা আইন ভঙ্গ করলে সংসদে প্রতিবাদ করি। আমরা আসলে মানুষই হতে পারিনি। দিনের পর দিন এসব ঘটনা ঘটে চলেছে আর কোথাও কোন রা নেই। তার মানে এই সমাজ অমন বর্বরতা মেনে নিয়েছে। আমরা অমন বর্বররা কেউ শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ সাংবাদিক, কেউ রাজনীতিক আমরা সবাই বর্বর। আর তা ই যদি না হয় তাহলে প্রকাশ্যে একটি ঘটনার পর শিক্ষামন্ত্রী বললেন স্থানীয় সাংসদের উপস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে কানে ধরে উঠ-বস করানোর ঘটনায় খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হবে। ভাবতে আজকাল অবাক লাগে না যে তিনি এখনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। করবেন কি করে যিনি ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনিতো তারই মতো একজন সাংসদ। পার্থক্য শুধু নারায়ণগঞ্জের ওই সাংসদ কোনো রকমে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। তৃতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পার হবার পর তাকে আর পড়াশোনার টেবিলে বসতে হয়নি। রাজনীতি তাকে তার চেয়ে উচ্চ শিক্ষিতদের কানে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজনীতিবিদদের আচরণ কী হবে না হবে তা তাদের শিক্ষা, রুচি ভদ্রতার ব্যাপার। কোনো আইন কানুন দিয়ে তাদের শেখানো যাবে না। কিন্তু সংসদ সদস্য যারা পদাধিকার বলে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হন তাদেরকে একটি নীতিমালার মধ্যে আনাই যায়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অধ্যায়ে বলেছিল, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা হবে এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ হবে। একটি সর্বসম্মত আচরণবিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল সুশাসনকে। সেখানে আরও একধাপ এগিয়ে, আরও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, সংসদের ভেতরে ও বাইরে সাংসদদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনানুগ বিধিবিধান করা হবে।কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর কে মনে রাখে নির্বাচনী ইশতেহারের কথা? সরকারের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ নেওয়া না হলেও নবম সংসদে ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি সরকারি দলের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন ২০১০’ শিরোনামে একটি বেসরকারি বিল এনেছিলেন, সরকারি বা বিরোধী দলের সবাই মিলে ওই বিলের মৃত্যু ওই সংসদেই ঘটিয়েছে। বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ২০১১ সালের ২৪ মার্চ বেসরকারি সদস্যদের বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পাস করার সুপারিশও করেছিল।ব্রিটেন, ভারত কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকান পার্লামেন্টে সাংসদদের জন্য আচরণবিধি রয়েছে। এসব দেশে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে সাংসদদের সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়, কোথাও কোথাও বেতনও কাটা হয়। বাংলাদেশের সাংসদরাই কেবল কোনো নিয়মনীতির মধ্যে থাকতে চান না। তবে শেষ পর্যন্ত দেখলাম শিক্ষককে অপমান করার ঘটনায় সরকার একটু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন “শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করানো, এটা আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়।...এটা কিন্তু একটা অপরাধ। যারা এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদেরকে নিশ্চয়ই শাস্তিভোগ করতে হবে। কারণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যায় না। এটা আমরা কোনোভাবেই বরদাশত করতে পারি না। ওই অর্ধশিক্ষিত সাংসদের বিরুদ্ধে নেওয়ার আগেই দেখা গেল সেই প্রধান শিক্ষককেই বরখাস্ত করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর নাম ক্ষমতা। আইনমন্ত্রী এখন কী করবেন কী বলবেন। হয়তো তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতেই পারবেন না। তারপরেও তিনি শাস্তির ব্যবস্থার কথা বলেছেন, তাকে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। কিন্তু সাংসদদের কথায় কথায় চড়-থাপ্পড় মারার অভ্যাসটা বদলানোর জন্য সংসদ কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়।লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/পিআর
Advertisement