মতামত

শেখ হাসিনার দেশে ফেরা, রাজনীতির হালধরা

আজ ১৭ মে। ১৯৮১ সালের এই দিনে শেখ হাসিনা বৃষ্টি বিধৌত ঢাকা বিমান বন্দরে পা রাখলেন। বিমানটি উড়ে এসেছে দিল্লী থেকে। সে সময় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা পরিচয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল  বঙ্গবন্ধুর গড়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়া। ক’দিন আগে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাঁকে সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর আগে প্রায় ৬ বছর স্বামী ও সন্তান নিয়ে জার্মানি ও ভারতে প্রবাসী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশে ফিরতে বাধা দেওয়া হয়েছিল, কোনো ভাবে ফিরলে প্রাণে বাঁচতে পারতেন কিনা বলা কঠিন। তবে আওয়ামী নেতৃত্ব সেই সময় দলের সভাপতি পদে তাঁকে নির্বাচিত করে প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। ১৯৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে সামরিক শাসক জিয়ার রহমান এবং তার পেছনে থাকা বাংলাদেশ- বিরোধী শক্তি ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছিল, বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করছিল, সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যে আবেগ তখন আবার ঘনীভূত হচ্ছিল  সেটিকে সংঘটিত করতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে নির্বাচিত করা অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল। এর ফলে দ্রুতই শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি নীরব ভালোবাসা নিয়ে যারা অপেক্ষায় ছিল- তারা আবার সংঘবদ্ধ হতে থাকে। শাসক গোষ্ঠী তখন শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনকে রোধ করার ক্ষমতা রাখে নি, জিয়াউর রহমানেরও তখন জনপ্রিয়তায় বিস্তর ধস নেমেছিল, অনেকেরই মোহভঙ্গ ঘটতে চলছিল। ফলে একেতো বঙ্গবন্ধুর কন্যা, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নব নির্বাচিত সভাপতি শেখ হাসিনার দেশের মাটিতে পা রাখাকে মোটেও ঠেকাতে পারেনি সরকার। তবে অপরাজনীতির ঘাতক গোষ্ঠী শেখ হাসিনার আগমন ঠেকাতে মোটেও কার্পণ্য করে নি, হুমকি-ধামকি, লিফলেট বিতরণ ও নানা অপপ্রচার চালিয়ে মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা মোটেও কম করে নি। তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। সব কিছু উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা এই দিন বিকেল বেলায় যখন ঢাকা বিমান বন্দরে পা রেখেছিলেন তখন ঢাকায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। এ যেন রাজনীতির আবর্জনা ধুয়ে-মুছে নেওয়ার কোনো প্রাকৃতিক ইঙ্গিতের কথাই ধারণা করা হচ্ছিল। শেখ হাসিনার ঢাকায় লাখ লাখ কর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। তার চোখে তখন গোটা পরিবারের সবাইকে হারানোর বেদনা, যা তার বাধভাঙ্গা কান্নাতেও হালকা হবার ছিল না। কোনো মানবিক আবেগ সম্পন্ন মানুষের পক্ষে এতো নির্মম বাস্তবতায় স্থির থাকা সম্ভব ছিল না। শেখ হাসিনাও সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে ছিলেন শোকে বিহ্বল, অশ্রুসিক্ত একজন সন্তান- যিনি এতোগুলো প্রিয় মানুষের মৃত্যুর ভার ছয় ছয়টি- বছর বিদেশ বিভূঁইয়ে বহন করে চলেছিলেন। আজ তিনি দেশে ফিরে জমে থাকা কান্নার প্রকাশ ঘটালেন। একই সঙ্গে মুখোমুখি হলেন দেশ ও জাতির রাজনৈতিক বাস্তবতার, জনগণের প্রত্যাশা পূরণের। তবে সেদিনের শাসক গোষ্ঠী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়টিকে কতোটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল জানি না। আমাদের দেশের নানা মহলও কতোটা শেখ হাসিনাকে নিয়ে আশাবাদী হতে পেরেছিল সেটিও জানি না। কেননা, তখনও পর্যন্ত অনেকেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিশন-ভিশন সম্পর্ক সচেতন ছিল না। জিয়াউর রহমান এবং ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের হোতাদের একটা ধারণা ছিল যে, শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সমর্থনশক্তি কিছুটা জেগে উঠবে হয়তো। কিন্তু সেটি তাদের রাজনীতির জন্যে হুমকি হয়ে পড়বে তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। আওয়ামী বিরোধী সকল শক্তির ধারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে কোনোভাবেই আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, কেননা, বাংলাদেশের জনগণকে এরিমধ্যে আওয়ামী বিরোধী ভাবাদর্শে গড়ে তোলা গেছে, সাম্প্রদায়িক এবং ভারত বিরোধী করা গেছে সফলভাবে এমনটিই ভাবা হতো। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের মতো হয়তো দুর্বল হতে পারে, নতুবা এটি চিরকালই বিরোধী দলের আসনে বসে চেঁচামেচি করে কাটাবে এমনটিই তাদের ধারণা ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন সব শক্তিকে বসানো হয়েছে যারা আওয়ামী উত্থানকে প্রতিহত করতে যা যা করা দরকার ছিল- তা তারা করতে মোটেও দেরি করেনি। সুতরাং জিয়াকেন্দ্রিক শক্তি কিছু অতিআত্মবিশ্বাসী ছিল।এর কারণে ১৯৮১ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এতোটাই বিভ্রান্ত এবং পথহারা ছিল, আওয়ামী লীগ তো অনেকটাই নেতৃত্বশূন্যই ছিল। তার ওপর এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা এতোটাই তীব্র ছিল যে, এসবকে প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে দাঁড়ানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এর ওপর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান নিহত হলে পর্দার অন্তরালে এসব কিসের দ্বন্দ্ব বা কিসের আলামত- তাও বোঝা যাচ্ছিল না। তেমন একটি ঘোলাটে সামরিক শক্তি নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার সময়ে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলেন, নতুন করে সব কিছু গোছাতে লাগলেন, অভিজ্ঞতার অবস্থানটিও তখন তার ছিল যৎসামান্য, দলের রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ, দেশের বাস্তবতায়ক বিবেচনায় নিয়ে সামরিক শাসন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালকে ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন পর্যন্ত বেশ জটিল এবং দুরুহ কাজ ছিল। অধিকন্ত পিতার মতো তবে বরাবরই তিনিও ছিলেন ঘাতকের ষড়যন্ত্রের টার্গেটে। তাকে হত্যা করার যড়য়ন্ত্র শুরু হয়েছে তখন থেকেই। ক্ষমতায় যাতে শেখ হাসিনা কোনোভাবে যেতে না পারেন এবং ষড়যন্ত্রের গোপন জাল বিছিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতরে মুখ লুকিয়ে যারা বেচেছিল। গোটা আশির দশক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। কিন্তু আন্দোলনের কোনো ফসলই তাকে ঘরে তুলতে দেয়নি নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারী মহল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে যে নেতিবাচক প্রচারণা নির্ধারণী মাঠকে উত্তপ্তও বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছিল সেটি বজায় থাকলে বাংলা দেশে গণতন্ত্র নির্ধারণের মাধ্যমে কোনো কালেই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ১৯৯৬ সালে মহল বিশেষের সকল হিসাব-নিকাশ ভেদ করে নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে, তাদের শাসনামলে বার বার দুর্ভিক্ষ ঘুরে আসে না, কোনো ধর্ম চলে যায় না, ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করে না, বরং এই আমলে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের নতুন ধারণা উপস্থাপিত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিযুক্তি স্থাপিত হয়, ভারতের সঙ্গে গঙ্গাচুক্তির স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশে পানি আসে, ভারত বিরোধী কমে আসে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ ফিলে আসা সম্ভব হয়। শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের শাসন আমলের অর্জন দেখে দেশের দক্ষিণপন্থায় বিশ্ববাসী মহল কতোটা শঙ্কিত হয়েছিল তা ১৯৯৯ সালে ৪ দলীয় জোট গঠনের মাধ্যমেই বোঝা যায়, কিন্তু ২০০১ সালে নির্বাচনে ৪ দলীয় জোটের ভূমিধস বিজয় অনেক ধারণা, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও মতাদর্শিক বিষয়কে ভেঙ্গেচুরে দেয়, পরবর্তী বছরগুলোতে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্যে জোট সরকার ও তাদের কর্মীবাহিনী যেভাবে বুলডোজার নামিয়েছিল, শেখ হাসিনাকে হত্যা করার গ্রেনেড উৎসব আয়োজন করেছিল-সেটিও বোঝার বিষয়। জঙ্গি গোষ্ঠীরা নব্বইয়ের দশক থেকে শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফাঁদ পেতেছিল। তারা অবশ্য এতে কোনোবারই সফল হতে পারে নি। কেন শেখ হাসিনাকে, অন্য কোনো নেত্রীকে নয়- বার বার হত্যার নীল নকশায় পড়তে হয়েছে- এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশে। আমার কাছে এর সাদামাটা উত্তর হচ্ছে, শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে দেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই ধীরে ধীরে জোরদার হয়েছে। ২০০৯ সালের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনসহ যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এরিমধ্যে একাত্তরের শীর্ষ ঘাতকদের রায় কার্যকরও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাতে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাস্তবায়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। তবে এই বিচারের বিষয়টি অনেক মহলই সহজভাবে নেয় নি, শেখ হাসিনার শেষ না করতে পারলে এই বিচার বন্ধ করা সম্ভব হবে না, সে কারণেই সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্র বার বারই আটা হয়েছে।  এ পর্যন্ত নেওয়া সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর সর্বোচ্চ শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাতে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহযোগিতা কোনো মহল চাইতে- তৎপর এমন সংবাদ দেশে বিদেশে বেশ ঝড় তুলেছে। এমন কি আই এস, চীন, মোসাদ, উলফাসহ নানা গোয়েন্দা গোষ্ঠীও ভেতরে ভেতওে শেখ হাসিনাকে উৎখাতে কাজ করছে বলেও সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি যে সত্যটি বুঝিয়ে দেয় তা হচ্ছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের  চাকাকে পেছনে ঘুরিয়ে দিতে দেশি এবং বিদেশি নানা অপশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বেশ সক্রিয় রয়েছে। তাদের সকলের কাছেই শেখ হাসিনা হচ্ছেন সবচাইতে বড় বাধা। কেননা, তিনি বঙ্গবন্ধুর রক্ত বহন করেছেন, কারো কাছে, অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার পাত্র নন-এটি তিনি এরিমধ্যে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠাও করতে পেরেছেন। সুতরাং, এমতাবস্থায় আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে, শেখ হাসিনা যদি ১৯৮১ সালে দেশে না আসতেন, রাজনীতির হাল না ধরতেন তা হলে বাংলাদেশের রাজনীতি কতোটা জঙ্গিবাদী, সাম্প্রদায়িক এবং প্রতিক্রিয়াশীল দেশি-বিদেশি অপশক্তি দ্বারা পরিচালিত হতো-তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এই সত্যটি দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, বাম রাজনৈতিক দলের নেতারাও খুব গভীরভাবে ভাবছেন বলে মনে হয় না। বস্তুত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নানা গোষ্ঠী নানা ষড়যন্তের ফাঁদ একের পর এক বিস্তার করছে। সেক্ষেত্রে তাদের চোখে শেখ হাসিনা হচ্ছেন মস্তবড় বাধা। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীর আচরণ আমাদের ভালো লাগছে না। সেটি আমরা গোপনও রাখছি না। তবে শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক অবস্থানটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের জন্যে অপরিহার্য, এর কোনো বিকল্প নেই। সেটি অস্বীকার করার সুযোগ দেখি না। তিনি ১৯৮১ সালে রাজনীতিতে হাসতে হাসতে আসেন নি, গতানুগতিক রাজনীতির জন্যেও আসেন নি। তিনি গত ৩৫ বছরে প্রমাণ করেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার মিশন-ভিশন নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছেন, ক্ষমতায় গিয়ে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে তার কোনো বিকল্প নেতা দেশে দেখা যাচ্ছে না। আমাদের একান্ত কামনা তিনি যেন আরো অনেক দিন বেঁচে থাকেন, দেশকে নেতৃত্ব দেন, দেশের কাঁধে চেপে বসা জঙ্গিবাদকে দূর করার ধারা অব্যাহত রাখেন। লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্টএইচআর/পিআর

Advertisement