তেলজাত পণ্যের তৈলাধারের ধারণক্ষমতাকে পেট্রোলিয়াম পণ্য সংশ্লিষ্টদের ভাষায় আলেজ বলে। আর এই আলেজ সংকটের কারণে প্রায় দেড় লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২৬ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার দুদিন নৌযান ধমর্ঘটের কারণে আমদানি করা পেট্রোলিয়াম জ্বালানি পরিকল্পনামাফিক খালাস করতে না পারায় জ্বালানিবাহী জাহাজের ডেমারেজ হিসেবে এই ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে বিপিসিকে।
Advertisement
তবে অভিযোগ রয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে আমদানি করা পরিশোধিত জ্বালানি নিয়ে চারটি জাহাজ চলে আসে। বিপিসির আমদানি করা পেট্রোলিয়াম জ্বালানি খালাস কিংবা হ্যান্ডলিং দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিভাগ চাইলে একটি জাহাজ ডেফার্ড (আগমন পিছিয়ে দেওয়া) করে দিলে অন্তত একটি জাহাজের ডেমারেজ কম হতো। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমদানি করা জ্বালানি খালাস করতে ব্যর্থ হলে কিংবা আমদানিকারকের কারণে জ্বালানি খালাস নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বিত হলে জাহাজপ্রতি চুক্তি ভেদে দৈনিক ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ গুনতে হয় বিপিসিকে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানি আমদানি করা জ্বালানি নিয়ে আসা জাহাজগুলো হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব পালন করে। জানুয়ারি মাসে হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে রয়েছে পদ্মা অয়েল কোম্পানি। নিয়ম অনুযায়ী, একটি মাদারভ্যাসেল বন্দরে আসার পর সার্ভে সম্পন্ন হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যেই জ্বালানি পণ্য খালাস নিতে হয়। এরপর ঘণ্টা থেকে শুরু করে দিন হিসাবে ডেমারেজ গুনতে হয় আমদানিকারককে।
আরও পড়ুনআগামী ৬ মাসে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বিপিসিরগ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত শিল্প ধ্বংসের চক্রান্ত: বিপিজিএমইএএদিকে গত ৭ জানুয়ারি পদ্মা অয়েল কোম্পানির পতেঙ্গা প্রধান ডিপোর ম্যানেজার মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বিপিসির কমার্শিয়াল অ্যান্ড অপারেশন শাখার মহাব্যবস্থাপককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, গত ৩১ ডিসেম্বর ৩২ হাজার ৯৯৮ মেট্রিক টন আমদানি করা ডিজেল নিয়ে চট্টগ্রামে আসে মাদারভ্যাসেল ‘এমটি সিওয়েজ স্কপলস’। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইন্দোনেশিয়ান প্রতিষ্ঠান পিটি বুমি সিয়াক পুসাকো (বিএসপি) ওই পার্সেল (তেলের চালান) সরবরাহ করে। ৪ জানুয়ারি ৩৩ হাজার টন ডিজেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে আরেক জাহাজ ‘এমটি ওশান সানরাইজ’। এই পার্সেল সরবরাহ করে সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড।
Advertisement
পরদিন ৫ জানুয়ারি ৩২ হাজার ৯৯৮ টন ডিজেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে চায়নিজ পতাকাবাহী ‘এমটি চ্যাং হ্যাং জিয়ান ফ্যাং’ নামের জাহাজটি। এটি সরবরাহ করে সিঙ্গাপুরভিত্তিক চায়নিজ প্রতিষ্ঠান ইউনিপ্যাক সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড। অন্যদিকে ৭ জানুয়ারি ১১ হাজার টন ডিজেল এবং ২২ হাজার টন ‘জেট এ-১’ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে মার্শাল আইল্যান্ডের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমটি এঞ্জেল স্টার’ । এটিও সরবরাহ করে ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড।
আরও পড়ুন৪৭ বছর ধরে ‘পরের ঘরে’ বিপিসিইআরএল-২ নির্মাণে এস আলমের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলসাত দেশের আট প্রতিষ্ঠান থেকে আসবে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন জ্বালানি তেলঅন্যদিকে গত ৭ জানুয়ারি পতেঙ্গাস্থ পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডসহ তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ডিপোতে ডিজেলের আলেজ ছিল (তেল রাখার সক্ষমতা) ৭ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু আমদানি করা জাহাজ থেকে ওইদিন পর্যন্ত তিন ডিপোতে ডিজেল সরবরাহ নেওয়ার কথা ১ লাখ ৯ হাজার ৯৯৬ মেট্রিক টন। এতে শুধু ডিজেলে ১ লাখ টনের বেশি আলেজ সংকট ছিল। একইভাবে পদ্মা অয়েলকে ২১ হাজার টন ‘জেট এ-১’ সরবরাহ নেওয়ার কথা থাকলেও কোনো আলেজ ছিল না। অর্থাৎ দেশের অ্যাভিয়েশন ডিপোগুলোতে ‘জেট এ-১‘ সরবরাহ দেওয়ার পর জাহাজে থাকা আমদানি করা ‘জেট এ-১’ খালাস নিতে পারবে পদ্মা অয়েল। কারণ সারাদেশে ‘জেট এ-১’ বিপণন ও সরবরাহ করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি।
এ বিষয়ে কথা হলে বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (কমার্শিয়াল অ্যান্ড অপারেশন) মণি লাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদেশে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য বিপিসির একটি ইমপোর্ট (আমদানি) শিডিউল থাকে। কিন্তু গত ২৬ ডিসেম্বর রাত থেকে দুদিন নৌযান ধর্মঘট থাকার কারণে জাহাজ থেকে কোনো ডিজেল লাইটারিং করা সম্ভব হয়নি। আবার প্রধান ডিপোতেও সবগুলো জাহাজের তেল একসঙ্গে খালাস নেওয়ার মতো আলেজ নেই। এতে জাহাজগুলো পরিকল্পনামাফিক হ্যান্ডলিংয়ে ব্যাঘাত ঘটে।’
আরও পড়ুন৮ বছর বন্দরে পড়ে আছে ‘মিথ্যা ঘোষণার পণ্য’, উদাসীন কাস্টমস১৪ বছর পর দাহ্য পণ্যের চার কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসভারত থেকে এলো ২৭ হাজার টন চালতিনি বলেন, ‘নিয়মমাফিক জাহাজ থেকে আমদানি করা তেল খালাস নেওয়া সম্ভব না হলে তখন ডেমারেজ দিতে হয়। একেক সরবরাহকারীর ক্ষেত্রে ডেমারেজের ধরন একেক রকম।’ এ সমস্যার কারণে ওই চার মাদারভ্যাসেলের ক্ষেত্রে ৭০ হাজার ডলারের কমবেশি ডেমারেজ আসতে পারে বলে জানান তিনি।
Advertisement
তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘২৬ তারিখ (ডিসেম্বর) ধর্মঘট শুরু হলেও ২৮ তারিখ রাতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু জাহাজগুলো আসে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারির মধ্যে। যেহেতু আগে দুদিন ধর্মঘট ছিল, সেহেতু যে কোনো একটি জাহাজ ডেফার্ড (আন্তর্জাতিক সরবরাহ প্রতিষ্ঠানকে শিডিউলভুক্ত জাহাজ পরে পাঠানোর অনুরোধ) করে দিতে পারতেন।’
তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শিডিউল থাকলেও জাহাজ ডেফার্ড করা যায়। এতে অন্তত একটি জাহাজে হলেও ডেমারেজ দিতে হতো না। এখন হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ ডলার পর্যন্ত ডেমারেজ আসতে পারে। একটি জাহাজ ডেফার্ড হলে ২০ হাজার ডলারের বেশি কম ডেমারেজ হতো।’ হ্যান্ডলিং পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে বিপিসিকে এ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
এমডিআইএইচ/ইএ/জেআইএম