খেলাধুলা

সময় বাড়লো আবার, ফেব্রুয়ারির মধ্যে ফ্লাডলাইট স্থাপনের নির্দেশ

সময় আর নদীর স্রোত বয়ে যায়। এ ঘাট ভেঙ্গে ওঘাট হয়। রং বদলায় অনেক কিছুর। শুধু শেষ হয় না বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সংস্কার কাজ। দেশের প্রধান এই ক্রীড়াভেন্যুকে অনেকে রসিকতা করে বলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কর্মকর্তাদের ‘সোনার ডিম পাড়ার হাঁস।’ সংস্কার মানেই তো কিছু মানুষের পকেট ভারী। কতবার যে সংস্কার হয় সে হিসাব করতে গেলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজ শেষ হবে।

Advertisement

অন্তবর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ডিসেম্বর ২০২৪ সালের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে। এমন নির্দেশ আগের দুই ক্রীড়ামন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও নাজমুল হাসান পাপনও দিয়েছিলেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তারা চলছেন সেই কচ্ছ্বপ গতিতেই।

সময় বেড়েছে বার বার। বাজেট বেড়ে কয়েক বার। সময় ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ আর বাজেট ৮০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে এখন ১৫৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ডিসেম্বর ২০২৪ এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আরো ৬ মাস সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন মাস নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে। স্টেডিয়াম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, জুনের মধ্যেও কাজ শেষ হয় কিনা সে নিশ্চয়তা নেই।

তবে এবার সময় ৬ মাস বাড়লেও বাজেট বাড়েনি এক পয়সাও। বৃহস্পতিবার জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মাহবুব মোরশেদ সোহেল জাগো নিউজকে জানালেন, ‘মন্ত্রণলায় প্রকল্প শেষ করার মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে বাড়িয়ে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত করেছে। আগের বাজেটেই বাড়িত ৬ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করা হবে।’ সময় বেড়েছে কিন্তু বাজেট বাড়েনি এটা নতুনত্বই বটে।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বিশাল সংস্কার কাজের টেন্ডার হয়েছে ভাগে-ভাগে। অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাক, মাঠ, গ্যালারিতে শেড, চেয়ার বসানো ও ফ্লাডলাইট আলাদা আলাদা টেন্ডারে কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে শেষ হয়েছে ২০ কোটি টাকার অ্যাথলেটিকস ট্র্যাক নির্মাণ।

নতুন ট্র্যাকে অ্যাথলেটদের অভিষেকও হয়ে গেছে। তবে ফুটবল এই মাঠে আবার কবে ফিরবে তা বলতে পারছেন না কেউ। সংস্কার কাজের হাতুড়ির বাড়ি পড়ার পর কেটে গেছে ৪২ মাসেরও বেশি। শুরু থেকে কচ্ছ্বপ গতিতেই এগুচ্ছে সংস্কার। মাঝে দুই মন্ত্রীর চেয়ার গেছে। বর্তমান উপদেষ্টার প্রথম কড়া নির্দেশও বাস্তবায়ন হয়নি।

স্টেডিয়াম সংস্কারের কাসুন্দি ঘাঁটতে ঘাঁটতে গণমাধ্যমকর্মীরাও ক্লান্ত। দিন যায়, বছর যায়, মাস যায়- শেষ হয় না এই স্টেডিয়াম নিয়ে বিশাল বিশাল প্রতিবেদন। খেলাধুলার সাথে জড়িয়ে থাকার পরিবর্তে এই স্টেডিয়ামের নাম এখন আষ্টেপিষ্টে লেগে আছে সংস্কারের সাথে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মানেই সংস্কার। চলছে, চলবে।

২০১৭ সালের কথা। তখন ৮০ কোটি টাকা বাজেটে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) তৈরি করেছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। কাজ শেষের সময়সীমা ছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বর। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ স্টেডিয়াম সংস্কার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনলে বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯৮ কোটি টাকা এবং কাজ শেষের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের জুন।

Advertisement

পরে কাজ শেষ করার সময় আরো ৬ মাস বাড়িয়ে করা হয়েছিল ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। শুরুর পর কাজ আবার থেমে যায়। ফের বাজেট ও প্রকল্পের সময় আরো বেড়ে যায়। ৬০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বাজেট বেড়ে ১৫৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা হওয়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বৃদ্ধি হয়ে চলে যায় ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বাকিটা ইতিহাস।

বর্ধিত বাজেটের মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে ৬০ কোটি ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার পর বাকি কাজের দরপত্র শেষে দুই মাস হাতে রেখে ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। তখন লক্ষ্য ছিল ২০২৪ সালের অক্টোবরের মধ্যে কাজ শেষ করার। তবে জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং দেশে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়।

ফুটবলের মাঠ প্রস্তুতের জন্য বাজেট ছিল ৬ কোটি টাকার মতো। তবে এই মাঠ প্রস্তুতের কাজ নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। বাফুফে বলছিল মাঠের কাজগুলো তাদের চাহিদামতো হয়নি। বিশেষ করে মাঠের সীমানা ও অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকের মধ্যে অপর্যাপ্ত দূরত্ব, মাঠে পানি দেওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্র নিয়েই বেশি আপত্তি ছিল বাফুফের। পরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রের পরিবর্তে ১২ টি পয়েন্টে পপআপ সিস্টেম করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

স্টেডিয়ামের গ্যালারির ওপরের শেড নির্মাণের দরপত্র হয়েছে দুই দফায়। প্রথম দরপত্র ছিল ২৯ কোটি টাকার কিছু বেশি। দ্বিতীয় দরপত্রে যোগ হয়েছে আরো ১০ কোটি টাকা। স্টেডিয়ামের পুরো গ্যালারিতে শেড স্থাপনের জন্য ব্যয় হবে ৪০ কোটি টাকার মতো। এখন দ্বিতীয় দফার কাজ চলছে।

আপাতত হাঁড়গোড়ের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে গ্যালারির শেড। ছাউনিতে কবে পরিপূর্ণতা আসবে সেই অপেক্ষায় সবাই। এরপরও রয়েছে অনেক কাজ। স্টেডিয়ামের চারপাশের রাস্তার সংস্কার ও শোভাবর্ধন শেষে কবে দেশের এই প্রধান ক্রীড়া স্থাপনা পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দাঁড়াবে সেই আভাস মিলছে না কোথাও থেকে। আপাতত সান্ত্বনা জুন ২০২৫।

৩৮ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এই স্টেডিয়ামে বসবে এলইডি ফ্লাডলাইট। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তাদের দাবি, কাজ শুরু হয়ে যাবে। লাইট চলে এসেছে বাংলাদেশে। বাধ সেধেছে পুরোনো টাওয়ার। ভার সইতে পারবে না বলে কিছু লাইট টাওয়ারে আর কিছু লাইট বসানো হবে শেডের ক্যানোপিতে। তা নিয়েও অনেকের মনে শঙ্কা আছে। শেডের ক্যানোপিতে লাইট স্থাপন করলে তা ঝুকিপূর্ণ হবে কি না! জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বলছে, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল এই কাজের ছাড়পত্র দিয়েছে।

সম্প্রতি প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে যে সভা হয়েছিল ক্রীড়া সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সভাপতিতে সেখানে বৃদ্ধিকরণ সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর ফ্লাডলাইট স্থাপন শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ফেব্রুয়ারির মধ্যে।

প্রকল্প পরিচালক ওই সভাকে অবহিত করেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বর্ধিত বাজেটের ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকার। যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৫৯ ভাগেরও বেশি। বাকি ৪০ ভাগের কাজ চলছে। শেষ হবে কবে, সে অনিশ্চয়তার মধ্যেই হয়তো কিছু মাস দমবদ্ধ অপেক্ষা ফুটবলামোদীদের। ফুটবলারদের পা যে এখানে পড়ে না বহুদিন!

আরআই/আইএইচএস/