দেশজুড়ে

খাঁ খাঁ করছে দুবলারচরের শুঁটকিপল্লী

মাছ সংকট দেখা দিয়েছে সুন্দরবনের দুবলারচরের শুঁটকিপল্লীতে। ফলে গভীর সাগরে জাল ফেলেও কাঙ্ক্ষিত মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। এই মুহূর্তে যেখানে শুঁটকিপল্লী নানান প্রজাতির মাছে পরিপূর্ণ থাকার কথা, সেখানে মাছ শুকানোর বেশিরভাগ ভারা (মাচা) ও চাতাল খালি পড়ে আছে। মাছ সংকটে খাঁ খাঁ করছে পুরো শুঁটকিপল্লী।

Advertisement

জেলে মজহাজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হয় দুবলার চরের শুঁটকি মৌসুম। শুরু থেকেই মাছের আধিক্য কম। দামি মাছ যেমন লইট্যা, ছুরি, রূপচাঁদা, লাক্ষা তেমন একটা ধরা পড়ছে না জালে। যা পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই কম মূল্যের ছোট চিংড়ি, চ্যালা ও পারসে মাছ। যার কেজি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

আকারভেদে এক কেজি লইট্যা বিক্রি হয় ৬০০ থেকে ৮০০, ছুরি ৭০০ থেকে এক হাজর, রূপচাঁদা দুই হাজার থেকে তিন হাজার এবং লাক্ষা বিক্রি হয় চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এসব মূল্যবান মাছের সংখ্যা খুবই কম। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন দুবলার চরের বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে থাকা চারটি চরের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। এছাড়া মাছ সংকটে শুঁটকি উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর রাজস্ব আয়েও ঘাটতি দেখা দেবে বলেও আশঙ্কা করছে বনবিভাগ।

তবে মাছ কম পড়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দুষছে বন বিভাগ। এর ফলে ধীরে ধীরে সাগরের গভীরতা কমছে। পরিবর্তিত হচ্ছে পানির গতিপথ। যে কারণে মাছের আধিক্য কম হতে পারে। অন্যদিকে সাগরে ঘন ঘন সৃষ্টি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে সাগর উত্তাল থাকায় ঠিকমতো জাল ফেলতে পারছেন না জেলেরা। মাছ কম হওয়ার এটিও একটি কারণ।

Advertisement

আলোরকোল শুঁটকি পল্লীর জেলে রাজ্জাক সরদার ও বিপুল গাইন বলেন, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবহাওয়া খারাপ থাকায় সাগরে কোনো জেলে নামতে পারেনি। তাছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সাগরে তেমন মাছও পড়ছে না।

বৃহত্তম শুঁটকিপল্লী আলোরকোলের শুঁটকি ব্যবসায়ী সুলতান মাহমুদ পিন্টু, হক বিশ্বাস, নাদিমুল ইসলাম ও আমানত আলী বলেন, তারা এ বছর শুঁটকি ব্যবসায় একেকজন দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু দুই দফা বৈরী আবহাওয়ায় মাছ ধরতে না পারা এবং এ বছর মৌসুমের শুরু থেকেই সাগরে পর্যাপ্ত মাছ না পড়ায় চালান বাঁচাতে পারবেন কি না সেই চিন্তায় পড়েছেন।

ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, মৌসুমের পাঁচ মাসে একেকজন জেলের বেতন ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। মাছ আহরণ বা শুঁটকি উৎপাদন না হলেও তাদের বেতন ঠিকই দিতে হবে। দুর্যোগে প্রায় এক সপ্তাহ জেলেরা সাগরে যেতে পারেনি। এখন মাছের ভরা গোন চলছে, অথচ জালে দামি কোনো মাছ উঠছে না। কুচা (ছোট) চিংড়ি, চ্যালা আর পারসে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তা ওজনে হালকা এবং দাম খুবই কম। শুঁটকি পল্লীর বেশিরভাগ চাতাল ও মাচা ফাঁকা পড়ে আছে। এখন যে পরিস্থিতি সামনেও যদি এভাবে মাছের সংকট থাকে, তাহলে লাভ দূরের কথা আসল চালান টেকানো দায় হয়ে পড়বে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দুবলার আলোরকোল টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দুবলা বিশেষ টহল ফাঁড়ির অধীনে আলোরকোল, মাঝেরকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া ও শ্যালার চরে এই সামুদ্রিক শুঁটকি পল্লী। এর মধ্যে আলোরকোল সবচেয়ে বৃহত্তম শুঁটকি উৎপাদন কেন্দ্র। মাছ ধরতে না পারায় গত সপ্তাহে শুধু আলোরকোলেই ১৬ থেকে ১৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। এছাড়া মাঝেরকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, শ্যালার চরসহ বাকি তিনটি ছোট শুঁটকি পল্লীতে ক্ষতি হয়েছে আরও প্রায় চার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা লোকসানে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

Advertisement

অপরদিকে মাছ সংকটের কারণে শুঁটকি উৎপাদন না হওয়ায় এক সপ্তাহে এক থেকে সোয়া কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ফিনজালের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় তিনদিন বন্ধ ছিল মৎস্য আহরণ। তখন রাজস্ব ঘাটতি হয় ৩০ লাখ টাকা।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরল করীম বলেন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি এবার মাছের পরিমাণ খুব কম। যাও পড়ছে তা কম দামের ছোট প্রজাতির মাছ। এতে মহাজনদের লোকসানের পাশাপাশি সরকারি রাজস্ব আয়েও ব্যাপক ঘাটতি হবে। গত বছর শুঁটকি খাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল সাত কোটি ২৩ লাখ টাকা। এবার ৮ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তা পূরণ হবে না। প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তন, দ্বিতীয়ত শুঁটকি মৌসুমের আগে হয়তো অধিক পরিমাণ মাছ শিকার হয়েছে। যার ফলে এখন মাছের পরিমাণটা তুলনামূলক কমে গেছে।

এফএ/এএসএম