চলতি (জানুয়ারি) মাসের প্রথম সাত দিনে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গত দুই বছরে এমন অনেকগুলো ছোটো-মাঝারি ভূমিকম্প দেখেছে বাংলাদেশ। ছোটো ছোটো ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। অথচ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি কমাতে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি কোনো সরকার।
Advertisement
ভূমিকম্পপ্রবণ বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত তিন মাসে বাংলাদেশের আশপাশে মৃদু ও তীব্র মাত্রার অর্ধশতাধিকের বেশি ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৫ বছরে ছোটো-বড় ভূমিকম্প হয়েছে দেড় শতাধিকের বেশি, যা আশঙ্কাজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃদু মাত্রার এসব ভূমিকম্প ইঙ্গিত দেয়, সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের চেয়ে সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
সবার আগে ভূমিকম্পে সচেতনতা জরুরি। ঢাকা শহরে বেশিরভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ভবনগুলো ভূমিকম্প নিরোধক কিংবা মজবুত করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সময় নিজেকে নিরাপদ রাখার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শুকনো খাবার, পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসাসমগ্রী সংগ্রহ করা দরকার।- ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী
Advertisement
৭ জানুয়ারি সকালে অনুভূত হওয়া রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে তিব্বতে নিহত শতাধিক। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতের বেশ কিছু অংশেও একই সময় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। প্রধান ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইনে অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলে ভূমিকম্প বেশ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৭৫ বছরে বড় ভূমিকম্প হয়নি, শিগগির হওয়ার আশঙ্কামার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় অবস্থিত। দুর্যোগ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোটোখাটো কম্পন দেশের আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে।
ঐতিহাসিকভাবে ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭-এর বেশি মাত্রার পাঁচটি ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্প এবং ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের প্রতিটিরই কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের মধ্যে এবং যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। এ অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প প্রায় ৭৫ বছর ধরে ঘটেনি, তাই শিগগির একটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
ছোটো-মাঝারি ভূমিকম্পে তীব্র ঝুঁকিতে বাংলাদেশ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেবার আতঙ্কেই মারা যান ছয়জন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যাওয়া ভারত ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটে গত শত বছরেও বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তাই এই প্লেটে সঞ্চিত হয়েছে দীর্ঘদিনের শক্তি। এটি যে কোনো মুহূর্তে ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে হাজির হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমন মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে না ঢাকা। মৃত্যু হতে পারে কয়েক লাখ মানুষের।
Advertisement
২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল বান্দরবান ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। তখন রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল।
এর আগে ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল। তখন রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে তিনবার ভূমিকম্প হয়। এর মধ্যে ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ২। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৫৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলে।
এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত। এছাড়া ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামের কাছাড় এলাকা।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে দুই দফায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে একটি অনুভূত হয় ২৯ আগস্ট। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট। এর আগে ১৪ আগস্ট আরেকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী সিলেটের কানাইঘাট এলাকায়। আগস্টের দুটি ভূমিকম্পের উৎসস্থল ডাউকি চ্যুতির মধ্যে ছিল।
২০২৩ সালের গত ৫ জুন ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে বঙ্গোপসাগরে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভ মিন্ট জানায়, এদিন সকালে বঙ্গোপসাগরে ৩ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের কাছে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে। বাংলাদেশ সময় সকাল সোয়া ৮টার দিকে আঘাত হানা ভূমিকম্পটির গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।
বুয়েট ও সরকারের একটি যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যেখানে তৈরি হবে সাত কোটি টন কংক্রিটের স্তূপ।
টেকটোনিক প্লেট ও ভূমিকম্পবাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্লেট টেকটোনিক্স (Plate Tectonics) ভূতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে ভূত্বক প্রধানত সাতটি বড় ও কয়েকটি ক্ষুদ্র গতিশীল কঠিন প্লেট দ্বারা গঠিত, যেগুলো নিম্নস্থ ভ্রাম্যমাণ উষ্ণ গুরুমণ্ডলীয় পদার্থের ওপর ভাসছে। প্লেটের বিচলন (movement) ও পারস্পরিক ক্রিয়া ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, পর্বত সৃষ্টি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ভূতাত্ত্বিক ঘটনাবলির নিয়ন্ত্রক বলে ধারণা করা হয়।
টেকটোনিক প্লেট যেভাবে ভূমিকম্পের অনুঘটকতিন ধরনের পারস্পরিক প্লেট সীমানার কথা জানা যায়। সমকেন্দ্রাভিমুখী সীমা, অপসারী সীমা ও পরিবর্তক চ্যুতি সীমা। পরিবর্তক চ্যুতি সীমা যখন দুটি প্লেট একে অপরকে অতিক্রম করে যায়, তখন তাকে পরিবর্তক চ্যুতি সীমা বলে। তিন ধরনের প্লেট বিচলনেই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়।
বঙ্গীয় অববাহিকার অধিকাংশই পড়েছে বাংলাদেশে। ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এর উৎপত্তি। ক্রিটেসিয়াস যুগের পূর্বে (সাড়ে বারো কোটি বছর আগে) বাংলাদেশের অংশবিশেষসহ (বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল) ভারতীয় প্লেট, অ্যান্টার্কটিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত থেকে গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে একটি বৃহৎ মহাদেশ গড়ে তোলে। বাংলাদেশের অবশিষ্টাংশের তখন অস্তিত্ব ছিল না। অতঃপর গন্ডোয়ানাল্যান্ডে ফাটলের ফলে ভারতীয় প্লেটের উত্তরমুখী সঞ্চরণ ও সর্বশেষ এশীয় প্লেটের সঙ্গে এর সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালা ও বাংলাদেশের ব-দ্বীপীয় সমভূমির সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুনদেশে বড় ভূমিকম্প হলে মাটির নিচের গ্যাস-বিদ্যুৎই জীবননাশের হুমকিসাত সকালে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো বাংলাদেশযখন তখন ভূমিকম্প, বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক সংঘর্ষ ইয়োসিন যুগে (৫ কোটি থেকে সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে) হিমালয়ের প্রারম্ভিক উত্থানের সময় প্রথম সংঘটিত হয়। নবীন ইয়োসিন যুগে (সাড়ে তিন কোটি থেকে ৪ কোটি) ভারতীয় প্লেট ও এশীয় প্লেটের মধ্যবর্তী টেথিস সাগরের সর্বশেষ চিহ্ন সম্ভবত বিলীন হয়ে যায়। এই সময়েই ভারতীয় প্লেটের অভিসরণ দিক দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষসহ উত্তর থেকে উত্তর পূর্ব দিকে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
ওলিগোসিন যুগ থেকে (সাড়ে তিন কোটি বছর আগে) প্লেট সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে এবং বিশাল নদীমালার জলরাশিতে দক্ষিণে আদি বঙ্গীয় অববাহিকা ভরে উঠলে উত্থিত হিমালয়ের অবক্ষেপ নেমে আসতে শুরু করে। মায়োসিন পরবর্তী সময় থেকে (আড়াই কোটি বছর তৎপরবর্তী) অববাহিকায় দ্রুত অবনমনের সঙ্গে হিমালয় পবর্তমালার দ্রুত উত্থানের ফলে বিপুল অবক্ষেপের সুতপের পাশাপাশি বৃহদাকৃতির বদ্বীপ গড়ে ওঠে।
৭ মাত্রার ভূমিকম্প যদি সীমান্ত এলাকায় হয় তাহলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হবে। ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হবে কারণ ঢাকার ভবনগুলো বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ।-অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ নামের এই সুবৃহৎ বদ্বীপের গঠন প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত আছে। এদিকে ভারতীয় প্লেটের এশীয় প্লেটের নিচে অধোগমন হিমালয়ের উত্তরাঞ্চলে একটি সন্ধি রেখা অঞ্চল সৃষ্টি করেছে। আর পূর্বে ইন্দো-বার্মান পর্বতসারি পূর্বাঞ্চলীয় প্লেট সংঘর্ষের অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। এশীয় প্লেটের সঙ্গে ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষ আজও অব্যাহত আছে। মাঝে মধ্যেই প্লেট সংলগ্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প এ কথাই প্রমাণ করে।
সক্রিয় তিনটি টেকটোনিক প্লেটবাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের আশপাশ দিয়ে তিনটি টেকটোনিক প্লেট গেছে। এর সংযোগস্থল সীমান্তের আশপাশে। যেমন আমাদের উত্তরে হিমালয় পড়েছে ইউরেশিয়ান প্লেটে। আমাদের অবস্থান ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেটে। আর আমাদের পূর্বে হচ্ছে মিয়ানমার মাইক্রো প্লেট। এ তিনটি প্লেটই আমাদের কানেক্টেড এবং সক্রিয়। প্লেটগুলোর মুভমেন্ট আছে। এগুলো প্রতি বছর পাঁচ সেন্টিমিটার বা ৫০ মিলিমিটার মুভমেন্ট করে। তার মানে, প্রতি বছর আমরা পাঁচ সেন্টিমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুভমেন্ট করছি। একইভাবে পুরো পৃথিবীও মুভ করছে।’
অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে সরকার ইক্যুইপমেন্টস কিনে দিয়েছে। শুধু ইক্যুইপমেন্টস দিয়ে হবে না। কারণ ভবন মেরামত না করলে ভবন চাপা পড়ে মানুষ মারা যাবেই। ঢাকা শহরে এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুতের অপরিকল্পিত লাইন ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।’
ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবার আগে ভূমিকম্পে সচেতনতা জরুরি। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য ভবনগুলো ভূমিকম্প নিরোধক কিংবা মজবুত করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সময় নিজেকে নিরাপদ রাখার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে শুকনো খাবার, পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসাসমগ্রী সংগ্রহ করা দরকার।’
আশপাশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন ও ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেন্ট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্প্রতি দুটি ভূমিকম্পে বাংলাদেশও কেঁপে উঠেছে। এগুলো ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল, কারণ প্লেট বাউন্ডারি। প্লেট বাউন্ডারি বরাবর এরকম প্রতিদিনই প্রচুর হয়, যেগুলো ছোটো ছোটো ভূমিকম্প, তবে মাঝে মধ্যে বড় ভূমিকম্পও হয়। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প যদি সীমান্ত এলাকায় হয় তাহলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হবে। ঢাকায় ক্ষয়ক্ষতি হবে কারণ ঢাকার ভবনগুলো বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ।’
বাংলাদেশে যত্রতত্র এবং অনুমোদনহীন বহুতল ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বৈধ করতে রিয়েল এস্টেটের চাপে সরকার ইতোমধ্যে নমনীয়। ভূমিকম্প হলে যে আশ্রয়স্থলে দাঁড়াবেন সেই জায়গাগুলোতে মেগা প্রকল্প হচ্ছে। দিনশেষে ভূমিকম্পের বিষয়ে ভালো সংবাদ কমই পাচ্ছি আমরা।- আদিল মুহাম্মদ খান
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্লেট বাউন্ডারির কাছাকাছি আছে, আগেও এখানে বড় ভূমিকম্প হয়েছে এবং আগামীতেও হতে পারে। ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ দেশ। সেই ঝুঁকি অনুযায়ী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভবনের নকশা করা নেই। পুরাতন ভবনগুলো নাজুক এবং নতুন ভবনগুলো গ্রাউন্ড প্যারামিটার অনুযায়ী করা হয়নি। এ কারণে ঝুঁকি অনেক বেশি। ভূমিকম্প সহায়ক ভবন বাংলাদেশেও করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ উন্নত দেশগুলো করেছে।’
কম্পন অ্যালার্মিং, বিল্ডিং কোড মানতে কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ভয়ংকরজাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশপাশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য অ্যালার্মিং। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে কিছু কিছু ভূমিকম্প বেশ কয়েক বছর ধরে হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী যেন ভবনগুলো বানোনো হয়। যে ভবনগুলো বানানো হচ্ছে সেগুলো সঠিক জায়গায় করা। বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ভয়ংকার। সরেজমিনে তদন্ত করার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও আগ্রহ কোনোটাই এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি তারা। বিপরীতে নিচু ভূমি ও জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন বানানোর যে প্রবণতা সেটা ১০ বছরে মহামারি আকারে বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জলাভূমি ভরাট করে ভবন হচ্ছে, যা অধিকাংশ আইন অমান্য করে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। কয়েক বছর পরে যখন মাস্টার সংশোধন হয় তখন বলে যেহেতু হয়ে গেছে তখন অনুমোদন না দিয়ে কী করার...। এই প্রবণতা যদি চলে বড় ভূমিকম্প লাগবে না, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় ৫ কিংবা সাড়ে ৫ মাত্রার হলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে।’
‘বাংলাদেশে যত্রতত্র এবং অনুমোদনহীন বহুতল ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো বৈধ করতে রিয়েল এস্টেটের চাপে সরকার ইতোমধ্যে নমনীয়। ভূমিকম্প হলে যে আশ্রয়স্থলে দাঁড়াবেন সেই জায়গাগুলোতে মেগা প্রকল্প হচ্ছে। দিনশেষে ভূমিকম্পের বিষয়ে ভালো সংবাদ কমই পাচ্ছি আমরা।’
কর্তৃপক্ষ বারবার লোকবল কম আছে দোহাই দিয়ে মূল কাজটি পালন করে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘এখানে কর্তৃপক্ষ বলতে রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্রের মন্ত্রণালয়গুলো সঠিক কাজটি করে না। কেউ আইন অমান্য করে সেটা দেখার ক্ষমতায় যদি না থাকে তবে কর্তৃপক্ষের থাকারই দরকার কী! রাষ্ট্রের অনেক সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখলাম না কর্তৃপক্ষের মধ্যে সংস্কার। কর্তৃপক্ষের অনাচারের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের ধরার ইতিহাস নেই।’
টিটি/এএসএ/জেআইএম