জাতীয়

বাসাবাড়িতে চুলা না জ্বলায় রান্নায় ভোগান্তি

সারাদেশে গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি দেখা দিয়েছে বাসাবাড়ির রান্নার কাজে। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্নাঘরে চুলা জ্বালানোই দায় হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে রান্নার কাজে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন অনেকে। সিলিন্ডার কেনার বাড়তি খরচ বহন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এতে মানুষের মধ্যে অভিযোগ এবং অসন্তোষও বাড়ছে।

Advertisement

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গ্রিন রোড, মহাখালী, আজিমপুর, আদাবর, কামরাঙ্গীরচর, আরামবাগ, ফকিরাপুল,  যাত্রাবাড়ী, মৌচাক, নাজিরাবাজার, মগবাজার, ধলপুর, কাঁঠালবাগান, মিরপুর, নয়াবাজার, কল্যাণপুর, মীরবাগ, মধুবাগ, নয়াটোলা ও তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে লাইনের গ্যাসের তীব্র সংকট। এসব এলাকায় দিনে রান্না করা দায় হয়ে পড়েছে। যদিও কিছুটা গ্যাস থাকে, তবে তাতে টিমটিম করে চুলা জ্বলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা রাতে রান্না করছেন, অনেকে বাড়তি টাকা খরচ করে ব্যবহার করছেন এলপিজি সিলিন্ডার।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আলেয়া খাতুন বলেন, পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে রান্না করার আশা ছেড়ে দিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও রান্না করা যায় না। আগেও সংকট ছিল, তবে কিছুদিন ধরে একেবারেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বলে তো আর লাভ নেই, হাজারবার বললেও গ্যাস পাওয়া যাবে না।

পাইপলাইনের গ্যাস দিয়ে রান্না করার আশা ছেড়ে দিয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও রান্না করা যায় না। আগেও সংকট ছিল, তবে গত বেশ কিছুদিন ধরে একেবারেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বলে তো আর লাভ নেই, হাজারবার বললেও গ্যাস পাওয়া যাবে না।- গ্রাহক আলেয়া খাতুন

Advertisement

কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা শিউলি আক্তার বলেন, গ্যাস পাওয়াই যায় না। দিনে তো লাইনের গ্যাসে রান্না করার উপায়ই নেই। রাতে কিছুটা পাই, তা-ও মিটমিট করে জ্বলে। বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার কিনেছি। এখন প্রতি মাসে লাইনের গ্যাসের বিল দিতে হয়, আবার সিলিন্ডারও কিনতে হয়। খরচ অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের জন্য কষ্ট হয়ে যায়।

আরও পড়ুন গ্যাস সংকটে দিশাহারা গ্রাহকরা লাইনের গ্যাস রেখেও কিনতে হচ্ছে সিলিন্ডার, গ্রাহক গুনছে বাড়তি টাকা জ্বলছে না বাসার চুলা, কারখানায় উৎপাদনে ধস

মিরপুরের বাসিন্দা পারুল বলেন, গ্যাস আসে যায় এমন অবস্থা। চুলায় রান্না বসালে দেখা যায় অর্ধেক রান্না হতেই গ্যাস নেই। বাধ্য হয়ে বিদ্যুতের হিটারে রান্না করি। বিদ্যুতে রান্না করলে খরচ বেশি হয়৷ নিয়মিত গ্যাস থাকলে এ বাড়তি খরচ হতো না৷ অনেক সময় রাতে যখন গ্যাস আসে তখন সারাদিনের রান্না করে রাখি। এভাবেই চলছে।

তিতাস গ্যাস সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীতে বেশকিছু এলাকায় গ্যাস সংকট বেশ পুরোনো। দীর্ঘদিন গ্যাস সংকট থাকলেও উৎপাদন কম থাকায় এর সমাধান করা যাচ্ছে না। তাছাড়া দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুটের বেশি। দেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১১০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এফএসআরইউ আর স্থানীয় উৎপাদন মিলিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হতো।

গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীতে থাকা এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি এফএসআরইউ থেকে মোট ৭২ ঘণ্টা আরএলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এতে সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ সাময়িক হ্রাস ও স্বল্প চাপ বিরাজ করবে।

Advertisement

গ্যাসের সাপ্লাই কম। আমরা গ্যাস কম পাচ্ছি। এজন্য ঠিকভাবে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। দিনে ১৯৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হলে আমরা ভালোভাবে চলতে পারি, কিন্তু আমাদের দেওয়া হচ্ছে ১৫০০ মিলিয়নের মতো।- তিতাসের কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান

বলা হয়, এই সময়কালে অন্য এফএসআরইউ (এমএলএনজি) দিয়ে দৈনিক প্রায় ৫৭০ থেকে ৫৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। ফলে বিদ্যুৎখাতে দৈনিক প্রায় ১৫০ থেকে ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাবে। এছাড়া অন্য খাতগুলোতে দৈনিক প্রায় ৫০-৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে বলেও জানানো হয়।

তবে এফএসআরইউ চালু হলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে গ্যাস পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগবে এবং সেই সময় পর্যন্ত ভোগান্তি সহসাই কমছে না বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র।

দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়মিত গ্যাস উৎপাদনের পর তা প্রক্রিয়াজাত করে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলনের সময় গ্যাসের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে (পিএসআই) থাকে চার হাজারের মতো। এ চাপের ওপর নির্ভর করে গ্যাসের প্রবাহ। জাতীয় পাইপলাইনে শুরুতে এক হাজার চাপে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে এটির চাপ আরও কমানো হয়।

গ্রাহক পর্যায়ে চাহিদা বুঝে গ্যাসের চাপ বজায় রাখার কাজটি করে গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলো। আবাসিক খাতে সাধারণত পাঁচ পিএসআই রাখা হয়। তবে সংকট থাকায় এটি আরও কমে এসেছে। এজন্য দিনের বেলা গ্যাসের অভাবে চুলা জ্বালানো দায় হয়ে পড়েছে।

তিতাস গ্যাসের অপারেশন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাসের সাপ্লাই কম। আমরা গ্যাস কম পাচ্ছি। এজন্য ঠিকভাবে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। দিনে ১৯৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হলে আমরা ভালোভাবে চলতে পারি, কিন্তু আমাদের দেওয়া হচ্ছে ১৫০০ মিলিয়নের মতো। এজন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন ৪ মাসে ১৬ হাজারের বেশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত টেক্সটাইল শিল্প

কবে নাগাদ এই সংকট কাটতে পারে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা বলতে পারবে। আমরা গ্যাস পেলে ডিস্ট্রিবিউশন করবো।

শীতকালে এমনিতেই গ্যাসের চাপ কিছুটা কম থাকে। মেরামতের জন্য একটি এফএসআরইউ বন্ধ থাকার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। এটি চালু করা হয়েছে। শিগগির পরিস্থিতির উন্নতি হবে।- পেট্রোবাংলার ইমাম উদ্দিন শেখ

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন) মো. ইমাম উদ্দিন শেখ জাগো নিউজকে বলেন, শীতকালে এমনিতেই গ্যাসের চাপ কিছুটা কম থাকে। মেরামতের জন্য একটি এফএসআরইউ বন্ধ থাকার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। এটি চালু করা হয়েছে। শিগগির পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এলএনজি টার্মিনাল মহেশখালীতে, গ্যাস সাপ্লাই শুরু হলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে পৌঁছাতে একটু সময় লাগে। এজন্য একটু দেরি হচ্ছে। আশা করছি গ্যাসের সরবরাহ দ্রুত স্বাভাবিক হবে।

তবে দ্রুতই সংকটের স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা। কিছুদিন পর পর একটা এফএসআরইউ বন্ধ হলে সংকট শুরু হয়ে যায়। সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও আমাদের ২৫ শতাংশ ঘাটতি থাকে। এখন মেরামত বা অন্য কোনো কারণে একটি এফএসআরইউ বন্ধ হলে সংকট তো হবেই।

‘এগুলোর একটি স্থায়ী সমাধান দরকার। এটি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে গেছে। দুটির পাশাপাশি আমাদের আরও একটি এফএসআরইউ প্রয়োজন, যেন কোনো সমস্যা হলে সেটি দিয়ে সরবরাহ চালিয়ে নেওয়া যায়’- যোগ করেন এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ।

এনএস/এমকেআর/এএসএম