বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ আমলের মডেল অনুসরণ করে তৈরি। উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা দক্ষতা, নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি অন্যান্য ক্যাডারের ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাকে এ পদে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে, যা প্রশাসনের কার্যকারিতা ও ভারসাম্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
Advertisement
কেন উপসচিব পদ শুধুমাত্র প্রশাসন ক্যাডারের জন্য থাকা উচিত? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটি বিষয় লক্ষ্য করা দরকার—বাংলাদেশে অনেকেই বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণ, যেমন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিং, সম্পন্ন করার পরেও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছেন। যখন এটা সম্ভব, তখন শুধু প্রশাসন ক্যাডারের জন্য উপসচিব পদ কেন সংরক্ষিত থাকবে? এ বিষয়ে কিছুটা ভাবনার সুযোগ তো অবশ্যই রয়েছে!
তবে, প্রশাসন ক্যাডারের জন্য উপসচিব পদ সংরক্ষণের পেছনে কিছু যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে:১. মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের দক্ষতা:
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে কাজ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
Advertisement
• তারা সরাসরি জনগণের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্যকর সমাধান খুঁজে পান।• এই অভিজ্ঞতা তাদের নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে দক্ষ করে তোলে।অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা সাধারণত দপ্তরকেন্দ্রিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, যা তাদের এই ধরনের নেতৃত্ব প্রদানে উপযুক্ত করে না।
২. প্রশাসনিক কাঠামোর ভারসাম্য রক্ষা:
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পান।• অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি পদোন্নতির সুযোগ কমিয়ে দেবে, যা প্রশাসনের স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।• এটি কর্মকর্তাদের মনোবল ভাঙবে এবং প্রশাসনের কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
৩. কেন্দ্র ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বজায় রাখা:
Advertisement
মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কেন্দ্রে আসা কর্মকর্তারা কার্যকর সমন্বয় করতে সক্ষম হন।• অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এই অভিজ্ঞতা না থাকায়, তাদের নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেবে।
৪. কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা ও কর্মদক্ষতা হ্রাস:
অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি প্রশাসনের ভেতরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে।• এটি দ্বন্দ্ব বাড়াবে এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও জটিল করে তুলবে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ: যুক্তরাজ্যের মতো কাঠামো অনুসরণ;বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো অনেকটা ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করে। তাই যুক্তরাজ্যের উদাহরণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
যুক্তরাজ্যের Fast Stream Officers Program:যুক্তরাজ্যে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক পদে নেতৃত্বের জন্য Fast Stream Program রয়েছে।• উচ্চ পর্যায়ের পদ সংরক্ষণ: এই পদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্বাচন করা হয়।• দায়িত্বের সুনির্দিষ্ট বিভাজন: বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের বিশেষায়িত দপ্তরে কাজ করেন, কিন্তু নেতৃত্বের জন্য
বিশেষায়িত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।• ফলাফল:• দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে।• প্রশাসনিক কাঠামোতে দায়িত্বের ভারসাম্য এবং কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রাসঙ্গিকতা:• দায়িত্ব বিভাজন সুনির্দিষ্ট থাকলে প্রশাসনের কার্যকারিতা বাড়ে।• নেতৃত্বের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা কাঠামোকে স্থিতিশীল রাখে।
অন্যান্য আন্তর্জাতিক উদাহরণ১. ভারত:ভারতের সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা (IAS) মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে নেতৃত্ব দেন।২. যুক্তরাষ্ট্র: Senior Executive Service (SES) কাঠামোতে উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের জন্য অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বাঁছাই করা হয়।৩. অস্ট্রেলিয়া:অস্ট্রেলিয়ার অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিস (APS) কাঠামোতে উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।৪. চীন:চীনের Civil Servants System কাঠামোতেও নির্দিষ্ট ক্যাডারের কর্মকর্তারা উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব প্রদান করেন।কেন অন্যান্য ক্যাডারের অন্তর্ভুক্তি ক্ষতিকর?
১. দক্ষতার অভাব:
মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ছাড়া নেতৃত্বে আসা কর্মকর্তারা জনগণের সমস্যার বাস্তব সমাধান দিতে ব্যর্থ হবেন।
২. কাঠামোগত সংকট:
নির্বাচিত কর্মকর্তাদের প্রবেশ প্রশাসনের ভেতরে অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে।
৩. নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে:
যারা মাঠ প্রশাসনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত, তারা কার্যকর নীতিনির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়নে সমস্যা তৈরি করবেন।প্রস্তাবনা;
১. উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষণ রাখা উচিত।২. নেতৃত্বের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে হবে।৩. যুক্তরাজ্যের Fast Stream এবং যুক্তরাষ্ট্রের SES কাঠামো থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেও দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা উচিত।৪. মাঠ ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সমন্বয় বজায় রাখতে অভিজ্ঞ ও দুর্নীতিমুক্ত কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে আনা উচিত।
আরও পড়ুন গণতন্ত্রের নতুন দিগন্তে এগিয়ে চলো বাংলাদেশউপসংহার: রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের গল্প এবং আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো;বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকারিতা, দক্ষতা এবং নেতৃত্ব তৈরিতে একটি সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদান করে। তবে এটি দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং সিদ্ধান্তহীনতার কারণে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতা যেমন সমস্যার প্রকৃত সমাধান না খুঁজে বারবার ভুল পথে চলার কারণে সময় ও সম্পদ অপচয় হয়েছিল, আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোও যেন সেই একই পথে হাঁটছে।
আমরা নানাভাবে প্রশাসনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি, কিন্তু দুর্নীতির জাল এবং দক্ষ নেতৃত্বের অভাব আমাদের বারবার পেছনে টেনে ধরছে। একটি জুতার মতো যদি আমরা আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো দুর্নীতিমুক্ত করতে পারতাম, তবে বাংলাদেশ সত্যিকারের একটি উন্নয়নশীল এবং গণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারত। তবু কেন আমরা এই দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন গড়ে তুলতে পারি না? কারণ মূল সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আমরা কাঠামোর ভারসাম্য নষ্ট করার মতো সিদ্ধান্তে মনোযোগ দিচ্ছি।
একটি দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি হতে পারে। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য উঁচু পদগুলো সংরক্ষণ এবং নেতৃত্বের জন্য দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সুনির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করাই সেই ভিত্তি নির্মাণের পথ দেখাতে পারে। অন্যথায়, আমরা শুধুই সমস্যার বৃত্তে ঘুরতে থাকব, সময় ও সম্পদ নষ্ট হবে, কিন্তু সমাধান মিলবে না।
আমাদের শুধু কাঠামোতে নয়, মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। সততা, দক্ষতা এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠুক একটি উন্নত বাংলাদেশ, যেখানে প্রশাসনিক নেতৃত্ব হবে দেশের স্বার্থে নিবেদিত। এই চেতনায়, আমরা একদিন ‘জুতা আবিষ্কার’-এর মতো সমস্যার সমাধান করে একটি দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য প্রয়োজন একটি দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ নেতৃত্ব, যা জনগণের সেবায় নিবেদিত এবং দেশের স্বার্থে কাজ করবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস