একুশে বইমেলা

বই থাকলে সভ্যতা-সংস্কৃতি টিকে থাকবে: শফিক হাসান

শফিক হাসান একাধারে কবি, রম্যলেখক ও কথাসাহিত্যিক। ২ যুগ ধরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সক্রিয় আছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে সাতটি মৌলিক রম্যগল্পগ্রন্থ। সম্পাদিত রম্যগল্পগ্রন্থ একটি। তিনি স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ‘উন্মাদ’সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রম্য আয়োজন, ওয়েব পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন ও নানা ধরনের সাহিত্যপত্রিকায় নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে আসছেন। কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণ, সাক্ষাৎকার, জীবন ও কর্ম, শিশুতোষ, গবেষণা, রম্যগল্পসহ সব মিলিয়ে প্রকাশিত বই বিশটিরও বেশি। ১৯৮৩ সালের ২ জানুয়ারি নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন শফিক হাসান। শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন পাহাড় ও সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রামে।

Advertisement

সম্প্রতি তার লেখালেখি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: বইমেলা অতি সন্নিকটে। বই নিয়ে এবার আপনার ব্যস্ততা কেমন?শফিক হাসান: বইমেলাকে নিয়ে ওই অর্থে আমার ব্যস্ততা কখনোই থাকে না। ব্যস্ততা শব্দটা বোধকরি বাণিজ্যিক বিষয়। সেটা জনপ্রিয় ধারার লেখকদের জন্যই প্রযোজ্য, যাদের বই বাজারে বিকোয়। আমি সারাবছরই টুকটুক করে লিখি। বই প্রকাশ করার মতো লেখা জমলে পাণ্ডুলিপি বানিয়ে প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দিই। পরে সেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের ‘গুদামঘর’ অন্ধকার করে রাখে! এজন্য অবশ্য আমি প্রকাশকদের দোষ দিই না। তারা বিনিয়োগ ওঠার নিশ্চয়তা না পেলে বই প্রকাশ করবেন কেন? অনেকের বই-ই সন্তোষজনক পরিমাণে বিক্রি হয় না। আমারও হয় না। তবে কে যেন মজা করে বলেছেন একবার—ভালো লেখকদের বই বেশি চলে না। এটা মনে করে হলেও আমরা নিজেদের প্রবোধ দিতে পারি!

জাগো নিউজ: বিপ্লব পরবর্তী এবারের বইমেলা কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?শফিক হাসান: এবারের বইমেলাকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ খুঁজে পাইনি এখনো। বইমেলাটা আদতে কেমন হবে, তা নিয়ে আপনি সালাহ উদ্দিন মাহমুদ যেভাবে সংশয়-আকীর্ণ বা দ্বিধান্বিত, আমিও তেমনই। শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, পেশাজীবীদের প্রতি অশ্রদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানসহ চারদিকে যেভাবে বেপরোয়া মনোভাব দেখছি, এর কিছুটা প্রভাব বইমেলায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটাই হয়তো স্বাভাবিক বিষয়।

Advertisement

সারাবছর কোনো পত্রপত্রিকায় লেখেন না, সাহিত্যসভা বা কোনো অনুষ্ঠানে যান না—তারাই বইমেলায় শোরগোল তোলেন। পরিবেশ নষ্ট করেন। ইউটিউবের মোটিভেশনাল স্পিকাররা যথারীতি এবারও সেলিব্রেটি তকমার গরিমায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কাঁপাবেন বলে আশঙ্কা করছি। এসবকে মেলার সৌন্দর্য ভাবতে পারি না; একধরনের উটকো বিপদ। নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, হিরো থেকে ভাঁড়ের সংখ্যা বাড়ছে ন্যাক্কারজনকভাবে। তারা মূলধারার লেখকদের টেক্কা দেওয়ার অপচেষ্টা করেন হয়তো, এটা অস্বস্তির। তরুণ পাঠককুলও ভেসে যান গ্ল্যামার-ভুবনের জোয়ারে!

বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যদি স্রোতে ভেসে যেতে না চান, তাহলে এসব নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়তো সম্ভব হবে। অতিরিক্ত স্বাধীনতার ফল কখনোই ভালো হয় না। এটা সবারই আমলে নেওয়া জরুরি। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা কখনোই এক জিনিস নয়। এখন যেহেতু প্রায় সবাই বৈষম্যবিরোধী অবস্থানে রয়েছেন, প্রতিফলন দেখতে চাই একুশে বইমেলায়ও। পাঁচ থেকে দশ টাকা দামের মধ্যে চা, অনূর্ধ্ব দশ টাকা মূল্যের শিঙাড়া-সমুচার বিক্রি তথা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে বলেই প্রত্যাশা করছি।

আরও পড়ুন

ইচ্ছেরা উড়ে গেছে: যাপিত জীবনের অভিঘাত ইভানার চিঠি: অবহেলিত নারীর প্রতিচ্ছবি

জাগো নিউজ: অনেক সময় পাঠকেরা বলেন, বইয়ের মূল্য বেশি; এ বিষয়ে কী বলবেন?শফিক হাসান: এটা সত্য কথা। বই যারা পড়েন; তাদের টাকা থাকে না। আর যাদের টাকা থাকে; তারা আবার বই কেনেন না তেমন একটা, পড়েনও না। এই সমস্যা নিয়ে বহু আগেই সৈয়দ মুজতবা আলী চমৎকার ব্যাখ্যা করে গেছেন। পাঠক বই কেনেন না বলে প্রকাশক দাম কমাতে পারেন না, আবার দাম বেশি বলে পাঠক বই কিনতে পারেন না! এ এক জটিল সমীকরণ। একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। তবে পাঠক যদি সত্যিই কম দামে বই পেতে চান, তার উচিত হবে বর্তমানে বেশি দামে হলেও বই কেনার অভ্যাস গড়ে তোলা। আশানুরূপ বিক্রি হলে প্রকাশকরা একসময় ঠিকই বইয়ের দাম কমাতে বাধ্য হবেন। অর্থনীতির সহজ সূত্রটা বলে—চাহিদা বাড়লে দাম কমে।

Advertisement

জাগো নিউজ: মানোত্তীর্ণ বই বলতে আপনি কী বোঝেন? কেমন বই প্রকাশ হওয়া উচিত?শফিক হাসান: মানোত্তীর্ণ বই মানে অবশ্যই স্বসম্পাদিত বা সম্পাদনা পর্ষদ কর্তৃক সম্পাদিত বইকে বুঝি। একজন লেখকই নিজের লেখার সবচেয়ে ভালো সম্পাদক। যেসব লেখক (নবীন কিংবা প্রবীণ) এই গুণ রপ্ত করতে পারেননি তাদের লেখা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করিয়ে তবেই বই আকারে প্রকাশ করা উচিত। কাজটা লেখক নিজে করতে পারেন, নতুবা প্রকাশকের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে পারে।

বইয়ের দুই-চারটা বাক্য পড়ে যেন পাঠকের বিরক্তি চলে না আসে। এটা সত্য, প্রচুর ভুলভাল বই প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠককে প্রতারিত ও বঞ্চিত দুটোই করা হচ্ছে। এটা লেখক বা প্রকাশক—কোনো পক্ষ থেকেই প্রত্যাশিত নয়। বই প্রকাশ নিয়ে ছেলেখেলা বন্ধ হওয়া জরুরি। টাকার জোরে কেউ বাঘের দুধ কিনে ফেলুক, সমস্যা নেই—বই যেন প্রকাশ না করে; প্রকাশককে যেন কিনে না ফেলে। প্রকাশক যেন অর্থকড়ির কাছে নিজেকে বিকিয়ে না দেন।

জাগো নিউজ: প্রকাশনা জগতের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?শফিক হাসান: প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রচুর সমস্যা আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সমস্যা আছে বলে এখানে সম্ভাবনাও আছে। শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রায় সবারই পড়ার মতো বইয়ের ঘাটতি আছে। চারপাশে বই প্রচুর, কিন্তু পড়ার মতো বই কয়টা আছে! আপনি যদি শিশুসন্তানের জন্য বই কিনতে যান, চোখ বন্ধ করে কিনতে পারবেন—খুব বেশি বই বাজারে নেই। আবার বাবা-মায়ের বয়স উপযোগী বই কিনে দেবেন? এখানটায়ও একটু ভাবতে হবে। কোন বইটা কিনবেন? কী ধরনের বই পড়তে তারা—বয়সী মানুষ পছন্দ করবেন! তরুণ-তরুণী ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়ারা সহজেই গল্প-উপন্যাস বা প্রবন্ধের বইয়ে ডুব দিতে পারে। সমস্যাটা হয় খুব কম বয়সী ও বেশি বয়সীদের জন্য। এদের কথা মাথায় রেখে লেখকরা যেমন লেখেন না, প্রকাশকরাও অনেকটাই উদাসীন। বই বিক্রি না হওয়া প্রকাশনা শিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করি। প্রকাশককে টিকে তো থাকতে হবে। আবার বই বিক্রি শুরু হলে সেটাই সম্ভাবনার প্রথম সোপান হিসেবে ধরে নিতে পারবো আমরা।

জাগো নিউজ: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? পাঠকের জন্য কী ভাবছেন?শফিক হাসান: লেখালেখি নিয়ে প্রচুর স্বপ্ন ও পরিকল্পনা আছে—এটা সত্য। আবার অনুকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিও তেমন একটা নেই। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বড় একটা উপন্যাস লিখবো, পরিকল্পনা আছে। আর লিখবো একশ একটা গল্প। এর বাইরে আরও কিছু বিষয় আছে, আপাতত না বলি। বাস্তবায়ন ঘটাতে না পারলে অন্যের কাছে যেমন ‘হেয়’ হতে হবে; তেমনই নিজের কষ্টও বাড়বে।

পাঠকের জন্য কিছু ভাবি না। বরং নিজের ভাবনাটাই পাঠকের মাঝে সঞ্চারিত করতে চাই। তবে একটাই চাওয়া পাঠকের কাছে—তারা যেন বই কেনেন। বলার কথাও এই একটাই—বই পড়ুন বা নাইবা পড়ুন, বই কিনুন। বেশি বেশি বই কিনুন। বই কিনলে প্রকাশক বাঁচবে, প্রকাশক বাঁচলে বইয়ের বাজার টিকে থাকে। আর বই থাকলে সভ্যতা-সংস্কৃতি এসব টিকে থাকবে। বই কেনার কোনো বিকল্প নেই। এত কম দামে বইয়ের মতো চমৎকার উপহার আর হয় না। পালা-পার্বণে, বিয়েতে, জন্মদিনে, যে কোনো অনুষ্ঠানে এখন বই উপহার দিলে লোকে হাসাহাসি করে, ঠাট্টা-বিদ্রূপ ছড়ায়। সেটা করুক তারা, তোয়াক্কা করবেন না। তবুও বই কিনুন আর অন্যকে উপহার দিন।

এসইউ/এমএস