একুশে বইমেলা

ইচ্ছেরা উড়ে গেছে: যাপিত জীবনের অভিঘাত

আবদুর রাজ্জাক

Advertisement

এই যে পৃথিবী, পৃথিবীর মঞ্চে নানা মানুষ বিরাজ করে। কেউ সংসার সাজায়। কেউ হয় সংসার বিবাগী। কেউ আবার হয় আত্মত্যাগী। প্রত্যেক মানুষের মনে কতোগুলো রঙিন ইচ্ছে থাকে। জীবনের বাঁক-বদলে, অভিঘাতে এসব ইচ্ছে মলিন হয়ে যায়। আবার কখনো কখনো চির সজীব হয়ে ওঠে। কেউ আবার হয়ে যায় ক্লান্ত। কখনো কখনো গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের দীর্ঘশ্বাস, জীবনযাত্রার সংকটে সুখে থাকা ব্যহত হয়। করপোরেট যুগে একদিকে মানুষের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অন্যদিকে কর্মহীন হওয়া নাগরিক জীবনে অশনিসংকেতও বটে।

গল্পকার কাদের পলাশ তার ‘ইচ্ছেরা উড়ে গেছে’ গল্পগ্রন্থ জীবনের এমন কিছু বাস্তবতা ও অভিঘাতের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে সাজিয়েছেন। ‘সন্ধ্যাদীপ’ গল্পের পাদপীঠে এমনই নাগরিক জীবনের আশঙ্কার চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রেমে-বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী আবার মিলনও সুদূরপরাহত নয়। ব্যর্থতার পরও আফফাজ ও মৌমিতা জীবনের উজান স্রোত ঠেলে মোহনায় এসেছিল। জীবনের এ সমস্ত মেলবন্ধন কিন্তু সমাজ মানতে চায় না। মৌমিতা দেখা করতে এসেই তালাবদ্ধ হয়ে গেলো।

‘নিজ ঘরে পরবাসী’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের মর্মন্তুদ কাহিনি ফুটে উঠেছে। একটি যুদ্ধ কোনো ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর ওপর কী পরিমাণ প্রভাব ফেলতে পারে, তার প্রমাণ এই গল্প। মানুষকে বাস্তুহারা করে। সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা দুর্বলদের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করে নেয়। এসবই কল্পনার পরতে পরতে ফুটে উঠেছে। সাবলীল ভঙ্গিতে গল্পকথক গল্পের পরম্পরা বর্ণনা করেছেন।

Advertisement

‘আত্মহারা হওয়ার গল্প’ কয়টি জেলে পরিবারের। জেলেদের জীবনযাপন, তাদের সামগ্রিক বিষয় ফুটে উঠেছে এতে। ‘সম্পর্কগুলো স্বার্থের’ গল্পটিও নিখুঁতভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে সাজিয়েছেন।

আরও পড়ুন ‘প্রিয় ধান’ নিয়ে এসেছে ‘দেয়াঙ’  বাংলা ভাষার চিরায়ত উপদেশমূলক কবিতা 

‘ইচ্ছেরা উড়ে গেছে’ একটি পারিবারিক টানাপোড়েনের আখ্যান। অর্থ-বিত্তের অভাবে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি লোপ পায়। তাছাড়া কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা থেকে মানুষ মুক্তি চায়। ইচ্ছেরা উড়ে গেছে গল্পে মাওলানা আব্দুর রহিমের পারিবারিক নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে স্ত্রী অনন্যা কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না। তাই তার মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে এবং পুরোনো সম্পর্ককে জোড়াতালি দিতে মনস্থ করে। কিন্তু সবকিছু সহজে দুইয়ে দুইয়ে মিল হয় না।

‘অতৃপ্ত যাত্রা’ গল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের নানা অভিঘাত উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধা কেরামত উল্লাহ স্বাধীনতা যুদ্ধে কেরামতি দেখাতে পারলেও জীবন গল্পে এসেছে নির্মম পরিণতি। জীবনে ছেলে-মেয়ে এবং সমাজ ব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সামাজিক স্বচ্ছতার মুক্তি। সে রকম মুক্তি মেলেনি। তাই কেরামত উল্লাহ হতাশ হয়েছেন।

এছাড়া ‘অমীমাংসিত’, ‘কথার দেয়াল’, ‘অব্যক্ত কথামালা’, ‘বদল’, ‘অচেনা পথের বাঁকে’, ‘উত্তরাধিকারী ইচ্ছে’, ‘স্মৃতির ডায়েরি সোনালি আলো ছড়ায়’, ‘ভোরের আলোয় আঁধার নামে’, ‘ঘটনা পুরানো হলেও সত্য’, ‘প্রতিশ্রুতি, শেষ বিকেল’ গল্পগুলো বিচিত্র আনন্দ-বেদনার রঙে সিক্ত ও স্বতন্ত্র।

Advertisement

সর্বোপরি ‘ইচ্ছেরা উড়ে গেছে’ গল্পগ্রন্থের প্রত্যেকটি গল্প সুন্দর ও নিখুঁতভাবে সাজিয়ে গল্পকার সমাজের নানা বিচ্যুতি এবং মানুষের জীবনের নানা অভিঘাত তুলে ধরেছেন। আশা করি গল্পগুলো সবার ভালো লাগবে।

বই: ইচ্ছেরা উড়ে গেছেলেখক: কাদের পলাশপ্রচ্ছদ: তৌহিন হাসানপ্রকাশক: চৈতন্যদাম: ২২০ টাকা।

এসইউ/জিকেএস