মতামত

খারাপ সময়ে বাঁচতে হলে যা করতে হবে

মানুষের জীবনে ভালো এবং খারাপ সময় আসবেই। কিন্তু যখন সামনে ভয়াবহ খারাপ সময়ের আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে সতর্ক হওয়া এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া। বর্তমান বিশ্ব এক অস্বাভাবিক সংকটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, "আত্মহননের পথে মানবজাতি"—এমন একটি কথা যা শুধু শোনার মধ্যেই ভয় জাগায়। প্রথমে করোনা মহামারি, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ— এ দুটি ঘটনার প্রভাব সারা বিশ্বকে এমন এক অর্থনৈতিক দুর্দশায় ফেলে দিয়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ আজও অজানা।

Advertisement

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেমন ইউরোপ ও আমেরিকা এখন সংকটের সময় পার করছে, তখন আমাদের মতো দেশগুলোর অবস্থাও খুব ভালো নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, প্রবাসী আয় কমে গেছে, এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির জীবনে চরম সংকট ডেকে এনেছে। দারিদ্র্য বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে, আর মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে কীভাবে তারা নিজেদের জীবন বাঁচাবে এবং সামনের কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুত হবে।

নিজের অবস্থান বোঝার প্রয়োজনপ্রথমেই আমাদের নিজ নিজ অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। বর্তমানে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা বুঝতে হবে। ব্যাংকে, বাসায়, কিংবা অন্য কোথাও আমাদের মোট কত টাকা আছে, আমাদের সম্পদ ও দায় কতটুকু, সেই হিসাব খতিয়ে দেখা জরুরি। অনেকে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিকল্পনা করে থাকেন— প্ল্যান এ, প্ল্যান বি এবং প্ল্যান সি। অর্থনৈতিক সংকট সামনে রেখে আমাদেরও এই ধরনের পরিকল্পনা করা দরকার। যদি হঠাৎ কোনো কারণে আপনার আয় বন্ধ হয়ে যায় বা চাকরি হারান, তাহলে আপনি কী করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।

খারাপ সময় আসবেই, কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে সেই সময়কেও সফলভাবে অতিক্রম করা সম্ভব। তাই এখনই সচেতন হোন, জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিন এবং সামনে এগিয়ে যান। কঠিন সময়ে সচেতন মানুষই বেঁচে থাকে।

Advertisement

খরচ কমানোর অভ্যাস গড়ে তুলুনযে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি এবং সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসতে পারে, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের খরচে লাগাম টানতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে কেবল প্রয়োজনীয় জিনিসের পেছনে অর্থ ব্যয় করতে হবে। অনেকের অভ্যাস থাকে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার—যাকে বলা হয় ইম্পালসিভ বাইং। এখন সময় এসেছে এই অভ্যাস ত্যাগ করার। নতুন জামা-কাপড় না কিনলেও চলে, টেলিভিশন বা ল্যাপটপ পুরোনো হলেও আপাতত সেটি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।

আমাদের আয়ের পরিমাণ বাড়ছে না, বরং কমছে। একই সাথে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আগের তুলনায় টাকার মূল্য কমে গেছে। আগে এক লাখ টাকায় যেটা কেনা যেত এখন সেটার অর্ধেকও কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই লাইফস্টাইল পরিবর্তন করা জরুরি। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং সাশ্রয়ী হওয়াই সময়ের দাবি।

পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নিনযাদের কাছ থেকে আপনার পাওনা রয়েছে, এখনই সেটি আদায়ের জন্য উদ্যোগী হোন। সময় যতই খারাপ হোক না কেন, সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। যদি তখন সবাই সংকটে পড়ে যায়, তখন পাওনা আদায় করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এখনই সেই পাওনা টাকা ক্যাশ হিসেবে নিজের কাছে রাখুন, যাতে ভবিষ্যতের জন্য আপনি আর্থিকভাবে কিছুটা হলেও প্রস্তুত থাকতে পারেন।

অতিরিক্ত খরচ কমিয়ে আনুনখরচ কমানোর ক্ষেত্রে আমাদের জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে হবে। বাড়ির এসি, লাইট, ফ্যান কিংবা অপ্রয়োজনীয় গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। অনেকে অফিসে কাজ না করেও অতিরিক্ত সময় কাটান, যার ফলে বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যায়। অফিসিয়াল স্টেশনারি ব্যবহারে অযথা খরচ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এভাবেই আমাদের নিজেদের অভ্যাসের মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে এবং খরচগুলোকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

Advertisement

খাবার এবং দৈনন্দিন কেনাকাটায় সাশ্রয়ী হোনরেস্টুরেন্টে খাওয়া কমিয়ে দিন। একদিন বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার খরচ বাড়িতে রান্না করলে অর্ধেকেরও কম পড়ে। একইভাবে কফি কিংবা অন্যান্য বিলাসী খাবার রেস্টুরেন্টের পরিবর্তে বাসায় তৈরি করলে খরচ অনেকটাই কমে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর জন্য পাইকারি বাজারে যাওয়া যেতে পারে। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করলে দেখবেন মাস শেষে অনেক টাকা বেঁচে যাচ্ছে, যা খারাপ সময়ে কাজে আসবে।

আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজুনশুধু খরচ কমানোই নয়, আয় বাড়ানোর চিন্তাও করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে একাধিক ইনকাম স্ট্রিম তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং, পার্ট-টাইম জব, লেখালেখি— এসব মাধ্যমে আপনার দক্ষতা অনুযায়ী অতিরিক্ত আয় করা সম্ভব। খারাপ সময়ে অল্প আয়ও অনেক বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। তাই নিজের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে কীভাবে আয় বাড়ানো যায় সে বিষয়ে ভেবে দেখতে হবে।

সঞ্চয় অক্ষুণ্ন রাখুনআপনার সঞ্চয় যেন কোনোভাবেই খরচ না হয়, সেদিকে নজর দিন। দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ভেঙে ফেললে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদে পড়তে পারেন। বিশেষ করে ডিপিএস বা সরকারি সঞ্চয়পত্রের মতো দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ভেঙে ফেলা উচিত নয়। আপনি আপাতত খরচ কমিয়ে সেই সঞ্চয়গুলো অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করুন।

শরীরের যত্ন নিনসবশেষে, নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হোন। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং অসুস্থতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। কারণ স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে চিকিৎসার পেছনে প্রচুর টাকা খরচ হয়। একটু সতর্কতা আপনাকে মেডিকেল খরচ থেকে মুক্ত রাখতে পারে এবং ভবিষ্যতে সুস্থ, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল জীবন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

সময় কঠিন, এবং সামনে আরও কঠিন সময় আসতে পারে। কিন্তু এই সময়ে সচেতনতা, সাশ্রয়ী জীবনযাপন এবং আয় বাড়ানোর চেষ্টাই আমাদের রক্ষা করতে পারে। খরচ কমানো, পাওনা আদায়, সঞ্চয় বজায় রাখা এবং আয়ের নতুন পথ তৈরি করা—এসবই আমাদের টিকে থাকার হাতিয়ার হতে পারে। আর সেই সাথে নিজেদের শরীরের যত্ন নিয়ে সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা উচিত।

খারাপ সময় আসবেই, কিন্তু প্রস্তুতি থাকলে সেই সময়কেও সফলভাবে অতিক্রম করা সম্ভব। তাই এখনই সচেতন হোন, জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নিন এবং সামনে এগিয়ে যান। কঠিন সময়ে সচেতন মানুষই বেঁচে থাকে।

লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।

এইচআর/এএসএম