দেশজুড়ে

টাঙ্গাইলে এক বছরে ১৫৩ সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ১৩৫

টাঙ্গাইলে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৪ জন হতাহত হয়েছেন। এরমধ্যে নিহত ১৩৫ জন, আর আহত ১৩৯ জন। আহতদের অনেকে চিকিৎসার জন্য ভিটেমাটি বিক্রি ও ঋণ করে সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতদের অধিকাংশই পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এরই মধ্যে ২২ হতাহতের পরিবার সরকারি অনুদান পেতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদন করেছে।

Advertisement

টাঙ্গাইল পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে ১৩৫ জনের মৃত্যু এবং ১৩৯ জন আহত হন। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে আটজন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চ মাসে ২১, এপ্রিলে ১৩, মে মাসে ৬, জুন মাসে ১৯, জুলাইয়ে ৮, আগস্ট মাসে ৩, সেপ্টেম্বরে ১০, অক্টোবরে ১৩, নভেম্বরে ৬ এবং ডিসেম্বর মাসে ১০ জন নিহত হন।

অন্যদিকে, এসব দুর্ঘটনায় জানুয়ারি মাসে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২, মার্চ মাসে ২২, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৮, জুন মাসে ১২, জুলাইয়ে ১০, আগস্ট মাসে ৩, সেপ্টেম্বরে ১০, অক্টোবরে ১৩, নভেম্বরে ১ এবং ডিসেম্বর মাসে ৯ জন আহত হন।

এরমধ্যে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সখীপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। ১৮ ডিসেম্বর মধুপুরে পিকআপভ্যানের চাপায় রামকৃষ্ণ বাড়ি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন নিহত হন। তারা দুজন ভোরে আজান ও ইমামতি করতে মোটরসাইকেলে করে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। বিপরীত দিক থেকে আসা পিকআপভ্যানের সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ হয়। এদিকে একই উপজেলায় ২১ ডিসেম্বর আশ্রা বাজারে দুটি মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা-ছেলের মৃত্যু হয়।

Advertisement

অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ভূঞাপুর উপজেলার ন্যাংড়া বাজারের সামনে পিকআপভ্যানের চাপায় গোবিন্দাসী ইউনিয়নের দিলীপ কুমার পালের ছেলে জয়দেব পাল আহত হন। তিনি উপজেলার শমসের ফকির ডিগ্রি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক দ্রুত ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। এরপর সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকার যমুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। দীর্ঘ তিন মাসের চিকিৎসায় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা ব্যয় করে তার পরিবার। পরে জয়দেব পাল বাড়ি ফিরলেও তার ডান পা কেটে ফেলে দিতে হয়। হতদরিদ্র দিলীপ কুমার পাল ছেলের চিকিৎসায় নেওয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।

কালিহাতী উপজেলার কাগমারী ইছাপুর গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে পারভেজ তালুকদারের গত সেপ্টেম্বরের সখীপুরের বড়চওনা এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে যায়। চিকিৎসা করতে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্ত্রী-সন্তানের পরিবারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম হওয়ায় তার সংসারের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্ঘটনার আগে তিনি কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করতেন। এখনো তার ডান পা পুরাপুরি ভালো হয়নি। ধার-দেনা করে চিকিৎসা নিলেও এখন সেই দেনা পরিশোধ করতে পারছেন না। পাওনাদাররা টাকার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি বিআরটিএ অফিসের ট্রাস্টি বোর্ডে সহায়তার জন্য আবেদন করেছেন। ওই সহায়তা পেলে হয়তো কিছু দেনা পরিশোধ করতে পারবেন।

টাঙ্গাইল জেলা নিরাপদ সড়ক চাই’র (নিসচা) সহ-সভাপতি ফিরোজ আহমেদ বাচ্চু জানান, বহু মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার পর আর কেউ ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের খবর রাখে না। দুর্ঘটনার কবলে অনেক পরিবারের উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।

তিনি জানান, এখন যে হারে গ্রামগঞ্জে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। শহরের অলিগলি দিয়ে তিন চাকার গাড়িগুলো (সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা) বেড়েছে। এদের প্রতি কর্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি নেই বললেই চলে। এই তিন চাকার গাড়ি বা থ্রি-হুইলারের চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং নিরাপদ সড়ক আইন সর্ম্পকে কোনো ধারণা নেই। এসব কারণগুলো সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমানো যাবে। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে টহল ও ট্রাফিক পুলিশের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে তদারকি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নিরাপদ সড়ক আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন দাবি করেন তিনি।

Advertisement

দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. মো. তুহিন তালুকদার বলেন, চালকরা বেশি ট্রিপের আশায় পাল্লা দিয়ে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালান, গাড়ি চলানোকালে মোবাইল ফোনের ব্যবহার, সড়ক-মহাসড়কে থ্রি-হুইলারের দাপট, টহল পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশের সঠিক তদারকির অভাবে সাধারণত দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এছাড়া চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, চালকদের নিরাপদ সড়ক আইন সর্ম্পকে জ্ঞান না থাকাও দুর্ঘটনার কারণ।

তিনি জানান, এসব কারণগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজরদারি বাড়ালে সড়ক দুর্ঘটনা অবশ্যই কমবে। অভিভাবকদের অসচেতনতায় তরুণদের মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ায় বাড়ছে দুর্ঘটনা।

টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাবের সভাপতি অ্যাডভোকেট জাফর আহমেদ জানান, যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। চালকদের সড়কে নামার সঙ্গে সঙ্গে সড়ক আইন সর্ম্পকে সচেতন করা। একই সঙ্গে চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করাও জরুরি।

তিনি আরও জানান, টাঙ্গাইলের গ্রামগঞ্জে দিনদিন যেমন মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি দুর্ঘটনার সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বাড়ছে।

মোটরসাইকেল চালকদের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমেই অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার কথা জানান তিনি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) টাঙ্গাইলের সহকারী পরিচালক শেখ মাহতাব উদ্দিন জানান, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছরই ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে হতাহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে ২২ জন হতাহত আর্থিক সহায়তার জন্য ট্রাস্টি বোর্ডে আবেদন করেছেন। এরমধ্যে নিহতের সংখ্যা ১৮ এবং আহত রয়েছেন চারজন। যথাযথ যাচাই-বাছাই করে তদের সহায়তা দেওয়া হবে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) রাকিবুল হাসান রাসেল বলেন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেল চালকদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে না জানা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার তদারকির মাধ্যমে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এআরটি/জেডএইচ/এএসএম