জাতীয়

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড: প্রাথমিক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা যা বলেছেন

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তদন্ত কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনিসহ বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রাথমিক প্রতিবেদন তুলে দেন। প্রাথমিক প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

প্রাথমিক প্রতিবেদনে বুয়েট বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে

আগুনের উৎপত্তি ৭ নম্বর ভবনের ছয়তলা লিফট লবিসংলগ্ন করিডোর থেকে হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণে যার সত্যতা পাওয়া যায়।

২৬ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিট থেকে ১টা ৪০ মিনিটের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। প্রথম যখন আগুন শনাক্ত করা হয় তখন ফায়ার ফাইটারদের সাক্ষ্য ও উত্তর দিক থেকে নেওয়া ভিডিও পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আনুমানিক রাত ২টার সময় আগুন বিকশিত স্তরে চলে যায়।

Advertisement

সিসিটিভি ফুটেজে দৃশ্যমান বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সাধারণত সকেট প্লাগে লুজ কানেকশন, কেবলে ফলটি জয়েন্ট ও কন্টাক্ট সারফেসে অক্সিডেশন ইত্যাদির কারণে বৈদ্যুতিক স্পার্ক হয়ে থাকে। স্পার্ক সংলগ্ন এলাকায় ধোঁয়া ও আগুনের উৎপত্তি হয় যা ক্রমশ ফ্লাশওভারে পরিণত হয়। এটি একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, এ ধরনের অগ্নিনির্বাপণে ব্যবহৃত পানির প্রবাহে ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষের অধিকাংশ আলামত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আরও পড়ুন সচিবালয়ে আগুন ‘রিমোট কন্ট্রোল’ দিয়ে নাকি অন্য কিছু? সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবন সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব মানা হয়নি ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ, সাজসজ্জায় বেড়েছে অগ্নিঝুঁকি

ভবনে কোনো ধরনের ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম না থাকায় প্রাথমিক ও বিকশিত অবস্থায় আগুন শনাক্ত করা যায়নি। এছাড়া টানেল সদৃশ্য করিডরের ফল সিলিং অতি ধাহ্য পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত থাকায় আগুন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের লিফট ও সিঁড়ির অপরিকল্পিত নকশার কারণে চিমনি এফেক্ট সৃষ্টি হয়, যাতে অগ্নিশিখা দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছয়তলা থেকে ৭, ৮ ও ৯ তলায় ছড়িয়ে যায় যা ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।

করিডোরে আগুন প্রবাহকালে পাশের রুমগুলোর দরজা পুড়ে যায়, রুমের ভেতরে দাহ্যবস্তু (কাগজ, কাপড়, ফোম, কার্পেট ও ফার্নিচার) ইত্যাদি রক্ষিত থাকার কারণে রুমে আগুন প্রবেশ করে। বিভিন্ন রুমে ফুয়েলের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন রুম বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছয়তলার ৫২৪ নম্বর এবং আটতলার ৭০৪ নম্বর কক্ষ দুটির এয়ারকন্ডিশন থেকে রেফ্রিজারেটর নির্গত হয়ে প্রজ্জালনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে প্রতীয়মাণ হয় বলে পর্যবেক্ষণে বলা হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দলের পর্যবেক্ষণ

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক কোনো ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে নাশকতামূলকভাবে আগুনের সূত্রপাত ও বিস্তার হয়েছে কি না- তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতি ও মাত্রা বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের তিনটি সম্ভাব্য উৎপত্তিস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারে পরীক্ষা করে প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়।

Advertisement

শনাক্তকরণের কাজে যে তিনটি আধুনিক বিস্ফোরক ডিটেকশন ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো হলো ইউকের পোর্টেবল এক্সক্লুসিভ ট্রেস ডিটেক্টর, জার্মানির আইটিমাইজার এক্সক্লুসিভ ট্রেস ডিটেক্টর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাস এক্স একটু মিটারস সেপ স্পেকট্রোমিটার।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, মাল্টিচ্যানেল ফ্লোরোসেন্স টেকনোলজি, আইওএন মবিলিটি সেপ স্পেকট্রোমিটার পদ্ধতি ব্যবহার করে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। চারটি নমুনা পরীক্ষা করে কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়নি।

সংগ্রহ করা একটি নমুনা বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া যায়নি। এছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডগ স্কোয়াড মোতায়েন করে কোনো ধরনের বিস্ফোরকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অগ্নিকাণ্ডের উৎপত্তিস্থল নিশ্চিত করতে অধিকতর পরীক্ষার জন্য ৩০ ডিসেম্বর পুনরায় নমুনা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষা করে পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ

প্রতিটি ফ্লোরে ইন্টেরিয়র ডিজাইন অতিমাত্রায় দেখা যায়, যা উচ্চমাত্রার ধাহ্যবস্তু এবং আগুন বিস্তারে অত্যন্ত সংবেদনশীল। প্রতিটি তলার অধিকাংশ রুমে উচ্চ ও সহজ ধাহ্যবস্তু দ্বারা বিভাজন করা হয়েছিল। প্রত্যেকটা ফলস সিলিংয়ের ওপর বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক তার ও অন্যান্য তার ছিল। কোনো কোনো রুমের পরিমাপ অনুপাতে অপেক্ষাকৃত বেশি ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কাগজপত্র ও আসবাবপত্র ছিল।

৭ নম্বর ভবনটিতে অ্যালার্ম অ্যান্ড ডিটেক্টর সিস্টেম, কন্ট্রোল প্যানেল, অটো স্প্রিং কলার ইত্যাদি দ্বারা অগ্নিনিরাপত্তার সিস্টেম ছিল না এবং কোনো কোনো ফ্লোরে হোস পাইপ সিস্টেম থাকলেও তা ছিল অকার্যকর ও নজেলবিহীন। ফলে ম্যানুয়ালি লাইন খুলে প্রতিটি ফ্লোরে ফায়ার সার্ভিসের হোস পাইপে করে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ছিল সময়সাপেক্ষ।

আরও পড়ুন তদন্ত কমিটি: সচিবালয়ের আগুনে ৫ মন্ত্রণালয়ের ‘কোনো নথি পোড়েনি’ সচিবালয়ের আগুনে পোড়া কুকুরের মরদেহ বলে দেয় এটি ষড়যন্ত্র: সারজিস নাশকতার প্রমাণ মেলেনি, বৈদ্যুতিক ‘লুজ কানেকশন’ থেকে সচিবালয়ে আগুন

পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, সচিবালয়ের অভ্যন্তরে তিনটি আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভারে পানি পর্যাপ্ত মজুত না হওয়ায় দূরবর্তী স্থান ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন ও গেটের বাইরে বিশেষ করে পানিবাহী গাড়ি থেকে অনেক হোস পাইপ লে-আউটের মাধ্যমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়েছে। এছাড়াও ওয়াসা কর্তৃকও পানি সরবরাহ করা হয়েছে।

৭ নম্বর ভবনের ছয়, সাত, আট ও নয়তলায় দ্রুত গতিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রথমে ষষ্ঠতলায় আগুন নির্বাপণ করতে হয়েছে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সাত, আট, নয়তলায় অগ্নিনির্বাপণের সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৫ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পৌনে ১২টায় নির্বাপণ হয়।

তদন্ত কমিটির পরবর্তী কার্যক্রমে যা থাকছে

আগুনের উৎপত্তিস্থল থেকে ৩০ ডিসেম্বর যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাউন্টার আইইডি ফিউশন সেন্টারের পরীক্ষাগারে বিভিন্ন বিস্ফোরক ডিটেকশন ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। ঘটনা পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ৭ নম্বর ভবন ও আশপাশের ভবনের সকল সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আগুন বৈদ্যুতিক উৎস থেকে শুরু হয়েছিল কি না- তা অধিকতর রূপে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দগ্ধ বৈদ্যুতিক কেবল সেগমেন্ট জয়েন বক্স এবং ব্রেকারগুলোর নমুনার ওপর এক্স-রেডিওগ্রাফ, মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা, পোড়া ইনসুলেটরের রাসায়নিক গঠনের জন্য ফুরিয়ার ট্রান্সকম ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কপি করেও আগুনের কারণ সম্পর্কে সূত্র পাওয়া যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে বুয়েট পরামর্শক দল।

এমইউ/বিএ/এএসএম