অব্যাহতভাবে ডলার সংকটে শুরু হয় ২০২৪ সাল। বছরের শেষ মুহূর্তেও সংকট উত্তরণে কোনো সুসংবাদ নেই। বরং ধারবাহিকভাবে ডলারের বাজারের অস্থিরতা মাথায় নিয়েই শেষ হচ্ছে আরও একটি বছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, দেশে ডলারের দামে অস্থিরতার নেপথ্যে প্রধান কারণ ছয়টি। তবে নতুন বছরের শুরু থেকে ডলারের দাম আরও বাজারমুখী করার উদ্যোগ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Advertisement
২০২৪ সালের শুরু থেকে ডলারের বাজার ব্যাংকিং চ্যানেলে ১১০ টাকার মধ্যে ছিল। যদিও খোলাবাজারে দাম আরও দুই টাকা বেড়ে ছিল ১১২ টাকা। তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে দুই দফা দাম বাড়ে মার্কিন এ মুদ্রাটির। শেষ দিকে এসে হঠাৎই অস্থিরতা দেয় ডলার বাজারে। দাম বেড়ে উঠে যায় ১২৮ টাকায়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তা কমে এলেও আগের দামের চেয়ে ৩ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মৌখিক নির্দেশনার এ দামেই এখন ডলার কেনাবেচা চলছে।
সব মিলিয়ে পুরো বছরে ডলারের বাজারে দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয় তিনবার। যেখানে ব্যাংকিং চ্যানেল দাম বাড়ে ১৩ টাকা, আর খোলাবাজারে বাড়ে ১৭ টাকার মতো। তবে ডলারের বাজারে মাঝেমধ্যেই অস্থিরতা দেখা দিলেও অন্য বিদেশি মুদ্রাগুলোর ক্ষেত্রে তেমন হেরফের দেখা যায় না। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ না থাকলে মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা আরও দীর্ঘ হতো। যার প্রভাব পড়তো অন্য মুদ্রাগুলোর দামেও।
আরও পড়ুন
Advertisement
বাংলাদেশ গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। এই সময়ে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। যদিও খোলা বাজারে লেনদেন হচ্ছিল আরও বেশি দামে। দীর্ঘ মেয়াদে ডলার সংকটের প্রভাব বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও পড়েছে।
দেশে গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। এই সময়ে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। যদিও খোলাবাজারে লেনদেন হচ্ছিল আরও বেশি দামে। দীর্ঘ মেয়াদে ডলার সংকটের প্রভাব বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও পড়েছে
২০২১ সালের আগস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সংকটের কারণে সেটি এখন ২০ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনাসহ নানাবিধ পদক্ষেপ নিলেও কাটেনি বাজারে সংকট।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের (২০২৩ সালের) অক্টোবর থেকেই ১১০ টাকায় রয়ে যায় ডলারের দাম। সে ধারা ২০২৪ সালের শুরু থেকেও অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ একই দামে বিক্রি হতে থাকে মার্কিন এ মুদ্রাটি। তবে চলতি বছরের মে মাসে ক্রলিং পেগ বিনিময় হার চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
Advertisement
‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারে খুব বেশি বাড়ানো বা কমানো যায় না।
চলতি বছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য করা মুদ্রানীতিতে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়নো হয়। ক্রলিং পেগের মাধ্যমে ভিত্তি রেট দাড়ায় ১১৭ টাকা, যার সঙ্গে সর্বোচ্চ ১ টাকা বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সে হিসাবে রেট পড়ছিল ১১৮ টাকা।
বছরের শুরু থেকে ডলারের বাজার ব্যাংকিং চ্যানেলে ১১০ টাকার মধ্যে ছিল। যদিও খোলাবাজারে দাম আরও ২ টাকা বেড়ে ছিল ১১২ টাকা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে দুই দফা দাম বাড়ে। শেষ দিকে এসে হঠাৎই ফের অস্থিরতা দেয়। ডলারের দাম বেড়ে উঠে যায় ১২৮ টাকায়
তবে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিময় হার বাড়িয়ে আগস্টে ১২০ টাকা করা হয়। এতে খোলা বাজারের সঙ্গে রেমিট্যান্সের দর অনেকটা এক ছিল। হুন্ডি কমে যায়, বেড়ে যায় বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ। যদিও চলতি মাস ডিসেম্বরে কয়েক দিনের জন্য ডলারের দাম হঠাৎ চড়ে ১২৮ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।
ডলারের হঠাৎ এই দাম বাড়া নিয়ে তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে খানিকটা স্থিতিশীলতা ফেরে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা দরে ডলার লেনদেন করতে পারছে। সে হিসাবে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান করলে ব্যাংককিং চ্যানেলে ডলারের দাম ১৩ টাকা আর খোলা বাজারে বেড়েছে ১৭ টাকা। তবে অন্য মুদ্রাগুলোর ক্ষেত্রে দাম বাড়া-কমার তেমন প্রভাব দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন
১২৩ টাকার বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে পারবে না ব্যাংক রিজার্ভ সংকট রাতারাতি সমাধান হবে না: গভর্নর রিজার্ভ ছাড়ালো ২১ বিলিয়ন ডলারডলারের দাম বাড়ার কারণে প্রভাব কমে যায় হুন্ডির। এতে বৈধপথে রেমিট্যান্সের গতি বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। যেখানে গত বছরের পুরো সময়ে এসেছিল ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে ডলারপ্রতি ১২৫ টাকায় এলসি খোলা হচ্ছে। যদিও এলসির সময় এ হার ওঠানামা করছে। এতে সমালোচনাও তৈরি হচ্ছে। যদিও দাম ওঠানামার ব্যাখ্যাও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
বর্তমানে ডলারপ্রতি ১২৫ টাকায় এলসি খোলা হচ্ছে। যদিও এলসির সময় এ হার ওঠানামা করছে। এতে সমালোচনাও তৈরি হচ্ছে। যদিও দাম ওঠানামার ব্যাখ্যাও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বৈদেশিক দেনা পরিশোধ সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার বাজারে চাপ বাড়িয়েছে। রেমিট্যান্স আহরণে অ্যাগ্রিগেটরদের একচেটিয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ভূমিকা বাজারে বিনিময় হারকে অস্থিতিশীল করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ইনফ্লো-আউটফ্লো মিসম্যাচের কারণেও ডলারের বাজারে অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে রেমিট্যান্স আহরণের বিনিময় হার সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা প্রতি ডলার (ক্রস কারেন্সি হলে তা ক্রস ক্যালকুলেশন করে ১২৩ প্রতি ডলারের ঊর্ধ্বে হবে না) নির্ধারণ করেছে। ড্যাশবোর্ড বা ডাটা মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইএআর/এমকেআর/এমএস