সানজিদা জান্নাত পিংকি
Advertisement
আজকের দিনটি ২৭ ডিসেম্বর, একটি বিশেষ দিন। আমাদের হৃদয়ে চিরকাল স্মৃতিমন্দিরে জ্বলজ্বল করবে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নাম। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি শুধু একজন চিকিৎসক হিসেবে নয়, বরং মানবতার এক অনন্য মূর্ত প্রতীক রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আজ তার জন্মদিনে আমরা স্মরণ করি সেই মহান ব্যক্তিকে, যিনি জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। হয়ে উঠে ছিলেন জনতার বন্ধু।
১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান থানায় জন্মগ্রহণ করেন ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এক সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে মানবসেবার চেতনা প্রবাহিত হতে শুরু করে। পিতা-মাতার হাত ধরে তিনি শিখেছিলেন জীবনের মৌলিক সত্যগুলো-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের অটুট সম্পর্ক। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করার পর, উন্নত জীবনযাত্রার প্রলোভন তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। বরং তিনি দেশের জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে গভীরভাবে অনুভব করতে থাকেন এবং চিকিৎসকের ভূমিকায় তা সমাধানে আত্মনিয়োগ করেন।
তবে তার জীবন সত্যিকার অর্থে একটি ঐতিহাসিক মোড় নেয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময়, তিনি ভারতের আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি মেকশিফট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন, যখন চরম সংকটকালীন সময়ে আমাদের দেশের জনগণ দুর্ভোগে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাকে আরও দৃঢ় করে তোলে-তিনি উপলব্ধি করেন যে, মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষিত করতে হলে, শুধু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় নয়, একটি জনসচেতনতা ও সামগ্রিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
Advertisement
মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ড. জাফরুল্লাহ দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, যা ছিল বাংলাদেশের প্রথম কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল, দেশের প্রান্তিক জনগণের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্যসেবার সামাজিকীকরণের পথে এক বড় পদক্ষেপ নেন। এখান থেকেই তার পথচলা শুরু, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
১৯৮২ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ঔষধ নীতি প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে, দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধের মান এবং দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যার ফলে ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এই উদ্যোগটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে প্রশংসিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নীতির একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়াও তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় গণবিশ্ববিদ্যালয়, যা আজ বাংলাদেশের অন্যতম ব্যতিক্রমী ধারার প্রগতিশীল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিগণিত। এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানেই নয়, শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধের চর্চাও করে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীরা শুধু পেশাগত দক্ষতা অর্জন করেন না, পাশাপাশি মানবতার প্রতি তাদের দায়িত্ববোধের চেতনাও জাগ্রত হয়।
ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একদম সাধারণ মানুষের কথা ভাবা, তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সহানুভূতি এবং সর্বদা মানুষের জন্য কিছু ভালো কাজ করার বাসনা। তিনি ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক, একজন চিকিৎসক, একজন শিক্ষাবিদ, একজন উদ্ভাবক এবং সবচেয়ে বড় কথা একজন মানবতাবাদী। তার অসীম পরিশ্রম, চিন্তা ও কর্মপ্রেরণায়, তিনি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য খাতে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। তার কর্মকাণ্ডের প্রভাব আজও সমাজে বয়ে চলেছে এবং তা চিরকাল থাকবে।
Advertisement
ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল মানুষের জন্য নিবেদিত। তার কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষের সঠিক নৈতিকতা ও কর্মপ্রেরণার শক্তি কীভাবে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। তার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তার আদর্শকে নিজেদের জীবনে অনুসরণ করার সংকল্প গ্রহণ করার মধ্যদিয়েই এই অমর আলোকবর্তিকা প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন
২০২৪ সালে শিশুদের করা বিস্ময়কর যত রেকর্ড জীবনের ১০০ বসন্ত পার, প্রেমের পর ঘর বাঁধলেন দম্পতিলেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়
কেএসকে/এমএস