কোরআনের একটি সুরার নাম সুরা ‘মুতাফফিফীন’। শব্দটি ‘মুতাফফিফ’ শব্দের বহুবচন, অর্থ ওজনে কম দেয় এমন ব্যক্তি। এ সুরাটি শুরু হয়েছে ওজনে কম দেয় এমন ব্যক্তিদের শাস্তির ঘোষণা দিয়ে। আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়’। এ থেকে বোঝা যায় ইসলামে এটি কত গুরুতর গুনাহ এবং ‘মুতাফফিফ’ বা ওজনে কম দেওয়া ব্যবসায়ীরা কত নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
Advertisement
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ ألا يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوثُونَ لِيَوْمٍ عَظِيمٍ يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
মন্দ পরিণাম তাদের জন্যে যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে। সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে জগৎসমূহের রবের সামনে। (সুরা মুতাফফিন: ১-৬)
Advertisement
ওজনে হেরফের করতে নিষেধ করে আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اَقِیْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تُخْسِرُوا الْمِیْزَانَ.
তোমরা ইনসাফের সাথে ওজন ঠিক রাখ এবং পরিমাপে কম দিয়ো না। (সুরা আর-রাহমান: ৯)
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
Advertisement
وَ اَوْفُوا الْكَیْلَ وَ الْمِیْزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا.
পরিমান-ওজন সঠিকভাবে করবে, আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব দেই না। (সুরা আনআম: ১৫২)
আল্লাহর একজন নবি হজরত শোয়াইব (আ.) যার নাম কোরআনে বার বার এসেছে, তার জাতির ব্যবসায়ী বা বিক্রেতাদের ওজনে কম দেওয়ার অভ্যাস ছিল। কোরআনে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ তাআলার নির্দেশে শোয়াইব (আ.) তার জাতিকে এক আল্লাহ তাআলার ইবাদত করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি তাদেরকে এই গর্হিত গুনাহ ত্যাগ করারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اِلٰی مَدْیَنَ اَخَاهُمْ شُعَیْبًا قَالَ یٰقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَیْرُهٗ قَدْ جَآءَتْكُمْ بَیِّنَةٌ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاَوْفُوا الْكَیْلَ وَ الْمِیْزَانَ وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْیَآءَهُمْ وَ لَا تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِ بَعْدَ اِصْلَاحِهَا ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ.
আমি মাদইয়ানবাসীর কাছে তাদেরই ভাই শেয়াইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন মাবুদ নেই। তোমাদের রবের পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল এসে গেছে। সুতরাং তোমরা পরিমাণে ও ওজনে পরিপূর্ণ দাও, মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবেনা। আর দুনিয়ায় শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের পর ঝগড়া ফাসাদ ও বিপর্যয় ঘটাবেনা, তোমরা বাস্তবিক পক্ষে ইমানদার হলে এই পথই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর। (সুরা আরাফ: ৮৫)
কোরআনের আরও কয়েক জায়গায় আল্লাহ তাআলা নবি শোয়াইবের (আ.) দাওয়াতের কথা বলেছেন এবং তার জাতিকে ওজনে হেরফের করতে নিষেধ করার কথাও উল্লেখ করেছেন।
হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজনে কম দেওয়ার ফলে দুনিয়াতেই আল্লাহর শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلاَّ أُخِذُوا بِالسِّنِينَ وَشِدَّةِ الْمَؤُنَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ
যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কম দেয়, তখন তাদের ওপর দুর্ভিক্ষ নেমে আসে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায় আর তাদের ওপর জালেম শাসক চাপিয়ে দেওয়া হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪০১৯)
মুসলমানদের একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য সততা ও সত্যবাদিতা; সত্য বলা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া, সত্য প্রতিষ্ঠা করা, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে থাকা। ধোঁকা, প্রতারণা, ভাণ ও ভণ্ডামি থেকে দূরে থাকা। ওজনে কম দিয়ে ক্রেতার সাথে প্রতারণা যে ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা করে, তারা কখনও আদর্শ মুমিন হতে পারে না।
মিথ্যা, ধোঁকা ও প্রতারণা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মুনাফিকরা নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারে যেমন অসত্য কথা বলে, প্রতারণা করে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও মিথ্যাই তাদের স্বভাব। আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ
মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি; কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তা খেলাপ করে এবং আমানত রাখা হলে তাতে খেয়ানত করে। (সহিহ বুখারি: ৩৩)
ওএফএফ/জেআইএম