সাংবাদিকতা হলো সত্য অনুসন্ধান, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এটি সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে রাষ্ট্র সংস্কার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তবে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ভূমিকা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে বাধা সৃষ্টি করছে। এ প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, দায়িত্ব ও নৈতিকতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
Advertisement
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে আলোচনা করলে, কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ও কিছু চ্যালেঞ্জ উভয়ই লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র, যেখানে সাংবাদিকরা অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর কাজ করছেন। তবে, কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা এবং সঠিক তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে।
সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভূমিকা বাংলাদেশের উন্নয়নে অনস্বীকার্য। তবে বাস্তব চিত্র হলো, তাদের অনেকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারে এ ধরনের পরিস্থিতি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। একদিকে উন্নয়নে তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে এই দুর্নীতি গোটা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সাংবাদিকদের ভূমিকা এখানে দ্বিগুণ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তাদের উচিত সত্য উদঘাটন ও দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করা। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব পেশাগত নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কারণ সংবাদমাধ্যম সমাজের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজের মূল্যবোধকেও প্রতিফলিত করে।
Advertisement
সাংবাদিকতার ভূমিকা:১. তথ্যের সরবরাহ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি;সাংবাদিকরা জনগণের সামনে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য উপস্থাপন করেন। জনগণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে informed সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
উদাহরণ: রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সংবাদ গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল, যা আন্তর্জাতিকভাবে সচেতনতা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছিল।
২. জনমত গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি;সাংবাদিকতা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে জনগণের মধ্যে আলোচনা সৃষ্টি করে। সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি ন্যায়সংগত দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সাহায্য করে।
৩. সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ;সরকারের নীতিমালা ও কর্মকাণ্ডের ওপর সাংবাদিকরা নজর রাখেন এবং অনিয়ম প্রকাশ করেন। এটি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
Advertisement
উদাহরণ: সরকারি প্রকল্পে অনিয়মের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হয়।
৪. সামাজিক সমস্যার চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের প্রচেষ্টা;সাংবাদিকরা সমাজের দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় তুলে ধরেন, যা সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং সমস্যা সমাধানে চাপ প্রয়োগ করে।
৫. প্ল্যাটফর্ম তৈরি ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ;সাংবাদিকতা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যেখানে প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবং সমাজের উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী তাদের দাবি জানাতে পারে।
৬. সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ প্রচার;সাংবাদিকতা সমাজের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ তুলে ধরে। এটি সমাজের মধ্যে ঐক্য, বৈচিত্র্য ও সহনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে।
৭. জরুরি পরিস্থিতিতে তথ্য সরবরাহ;প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জাতীয় সংকটের সময় সাংবাদিকরা জনগণকে সময়োপযোগী তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করেন।
সাংবাদিকদের নৈতিকতা ও দায়িত্ব:সাংবাদিকদের নৈতিকতা ও পেশাদারত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্যের প্রচার এবং জনগণের আস্থার ভিত্তিতে সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিতে হবে।
১. সত্যনিষ্ঠতা:সাংবাদিকদের উচিত গুজব ও ভুয়া তথ্য এড়িয়ে যাচাই-বাছাই করা এবং সত্য প্রকাশ করা।
২. নিরপেক্ষতা:সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত মতামত ও পক্ষপাতিত্ব পরিহার করে নিরপেক্ষভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।
৩. জনস্বার্থ রক্ষা:তাদের দায়িত্ব হলো জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তথ্যের অপপ্রয়োগ রোধ করা।
৪. গোপনীয়তা বজায় রাখা:সংবাদ সংগ্রহের সময় উৎসের গোপনীয়তা রক্ষা করা সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্ব।
৫. সামাজিক দায়বদ্ধতা:সাংবাদিকদের উচিত জাতীয় ঐক্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশে কাজ করা এবং সমাজের বিভাজন বা হিংসা সৃষ্টির সংবাদ পরিহার করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চ্যালেঞ্জ:বাংলাদেশে সাংবাদিকতা বর্তমানে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা রাষ্ট্রের সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।
১. বাকস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা:সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও আইন, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অনেক সময় সাংবাদিকদের স্বাধীনতাকে সীমিত করে।
২. সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতা:বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের হয়রানি, গ্রেফতার বা শারীরিক হামলার ঘটনা তাদের পেশাদার দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়।
৩. দুর্নীতির প্রভাব:তথ্য সংগ্রহের সময় দুর্নীতি ও লোভের ফাঁদে পড়ে অনেক সাংবাদিক নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হন।
৪. পেশাগত দক্ষতার অভাব:সাংবাদিকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নেই, যা তাদের কার্যক্ষমতাকে সীমিত করে।
সমাধানের পথ:সরকারের করণীয়;• সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।• সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।• মিডিয়া নীতিমালা সংস্কার করে স্বাধীন ও স্বচ্ছ সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
সাংবাদিকদের করণীয়;• নৈতিকতা ও পেশাদারত্ব বজায় রেখে কাজ করা।• ভুয়া সংবাদ ও গুজব রোধে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
জনগণের করণীয়;• সাংবাদিকদের স্বাধীন কাজের জন্য সমর্থন প্রদান।• তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
উপসংহার:
সাংবাদিকতা রাষ্ট্রের সংস্কার এবং গণতন্ত্রের সুরক্ষায় একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। একটি স্বাধীন, শক্তিশালী এবং নৈতিক সাংবাদিকতা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিবর্তন সম্ভব। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক সংকট রয়েছে, সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব এবং নৈতিকতার মাধ্যমে সত্য উন্মোচন করতে পারেন, যা সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এ পরিবর্তনের জন্য সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা এবং পেশাগত নৈতিকতার নিশ্চয়তা প্রদান করা অপরিহার্য। সাংবাদিকরা যদি স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে এবং সততার সাথে কাজ করতে পারেন, তবে তারা রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। সরকারের উচিত সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন তারা অবাধে এবং নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন। জনগণের উচিত সঠিক তথ্য যাচাই করা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সমর্থন করা, যাতে গণমাধ্যম আরো শক্তিশালী এবং দক্ষভাবে সমাজের সংকটগুলি তুলে ধরতে পারে।
শেষমেষ, রাষ্ট্র, সাংবাদিক ও জনগণের একত্রিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাংবাদিকতার যে শক্তিশালী ভূমিকা, তা পুরো সমাজের উন্নয়নে এবং সুশাসনের পথে এক অনবদ্য পথনির্দেশক হয়ে উঠবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/এমএস