ভ্রমণ

উৎসমুখ ভরাট হয়ে তিন নালায় নামছে পানি, লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া

প্রকৃতিকন্যা সিলেটের অন্য সব পর্যটন কেন্দ্রের তুলনায় ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের শীর্ষে সাদাপাথর। যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতা ও সিলেট শহর থেকে নিকটবর্তী হওয়ায় সারাবছরই প্রকৃতিপ্রেমিদের ভিড় থাকে এখানে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে ধুঁকছে সাদাপাথর। কাগজে কলমে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও ন্যূনতম উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি এই পর্যটনকেন্দ্রে।

Advertisement

সম্প্রতি উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় তিন নালায় বিভক্ত হয়ে ভারত থেকে নামছে পানি। যার কারণে সাদা পাথরের বিছানার জল গড়ানোর সৌন্দর্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমিরা। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা পর্যটকরা ফিরছেন ফিকে মুখে। অবশ্য সাদাপাথরের তিনপাশে সুউচ্চ পাহাড়, মেঘ আর নৌকা ভ্রমণ আনন্দে কিছুটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করছে।

পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই। যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, সেটুকু স্থানীয় মানুষের হাত ধরেই হয়েছে। আর স্থানীয়রা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ করছেন। এতে স্থায়ীভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

Advertisement

অব্যবস্থাপনায় ‘সংকীর্ণ’ হচ্ছে জাফলং, পর্যটকদের দুর্ভোগ সিলেট ভ্রমণে যা কিছু দেখবেন বিছনাকান্দির অপরূপ সৌন্দর্য সিলেটের ডাউকি নদী ভ্রমণে কখন যাবেন, কোথায় থাকবেন?

২০১৬ সালে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায় সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি নামক সাদাপাথর এলাকাটি। পর্যটন শিল্পের বিকাশে অপার সম্ভাবনা থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটন করপোরেশনের দৃষ্টি না থাকায় অযত্ন ও অবহেলায় ধুঁকছে দেশের অন্যতম এই পর্যটন কেন্দ্র।

‘আগে একবার সাদাপাথরে এসেছিলাম। তখন পানির স্রোত ছিল। গোসল করে মন জুড়িয়ে ছিলাম। এখন পানি নেই। সেই আনন্দ পাইনি। তবে পাহাড় আর মেঘ দেখে বেশ ভালো লেগেছে।’- পর্যটক রাহিম বিন সিয়াম

সরেজমিনে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, উৎসমুখে পাথর জমে ভরাট হয়ে গেছে। যার কারণে একই পথে পানি নামার সুযোগ পাচ্ছে না। ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তিনটি নালায় বিভক্ত হয়ে প্রবেশ করছে। শুকনো মৌসুমে পানি কম থাকায় কোনো নালাতেই পানির স্রোত নেই।

একসময় শুকনো মৌসুমেও সাদাপাথরের বিছানায় স্বচ্ছ জলের স্রোতে ভেসে আনন্দে মেতে ওঠতেন তরুণ-তরুণীরা। কিন্তু এখন গাঁ ভেজানোর মতো পানি নেই। অবশ্য গা ভেজাতে না পারলেও নৌকা ভ্রমণ ও পাহাড়-মেঘ দেখে কিছুটা আনন্দিত পর্যটকরা।

Advertisement

বরগুনা থেকে আসা পর্যটক রাহিম বিন সিয়াম বলেন, ‘আগে একবার সাদাপাথরে এসেছিলাম। তখন পানির স্রোত ছিল। গোসল করে মন জুড়িয়ে ছিলাম। এখন পানি নেই। সেই আনন্দ পাইনি। তবে পাহাড় আর মেঘ দেখে বেশ ভালো লেগেছে।’

আরও পড়ুন

সিলেটে পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন জাফলংয়ে পিয়াইন নদীতে গোসলে নেমে ঢাকা রেসিডেন্সিয়ালের ছাত্র নিখোঁজ পর্যটকে মুখর জাফলং ও বিছনাকান্দি

রাহিমের বন্ধু আজহার উদ দ্বীন বলেন, ‘পানি যদি একদিকে আসতো তাহলে স্রোত থাকতো। পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি তিনটি পথ দিয়ে যাওয়ায় কোনোটিতেই পানি নেই।’

চাঁদপুর থেকে সাদাপাথর ঘুরতে আসা কলেজছাত্র ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘জায়গাটি বেশ সুন্দর। তবে নদী খনন করে নৌকা আসার পথ যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেভাবে মূল স্পটে পানি একপথে নামানোর ব্যবস্থা করলে আরও ভালো হতো। পানির স্রোত না থাকায় সেই আনন্দটা পাওয়া যায়নি।’ অবশ্য সিলেটের অন্য স্পটগুলোর চেয়ে এটি দেখতে বেশ ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এছাড়াও সাদাপাথরের মূল কেন্দ্রে পর্যটকদের জন্য নেই কোনো গণশৌচাগার। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় পর্যটকদের। বিশেষ করে মহাবিপদে পড়তে হয় নারীদের। এ বিষয়ে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।

‘ছুটি পাওয়ায় পরিবারের সবাই সাদাপাথর ঘুরতে এসেছি। জায়গাটা বেশ ভালো। কিন্তু নারীদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। বিশেষ করে ওয়াশরুম না থাকায় মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’-রাজনা বেগম

কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নের লক্ষ্যে মহাপরিকল্পনা নামক একটি উদ্যোগ নিয়ে ডিজাইন ও জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তারপর গেল কয়েক বছরে মহাপরিকল্পনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও ১৪০ ফুট সীমানা প্রাচীর ছাড়া দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন হয়নি।

আরও পড়ুন

খুলে দেওয়া হলো সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র, মানতে হবে শর্ত ষড়ঋতুর সব রূপ সিলেটে, পর্যটকদের ভিড় পর্যটকদের ভিড়ে চোরাই চিনি নিয়ে দৌড়ঝাঁপ, বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে

সিলেটের আখালিয়া সুরমাগেইট এলাকার বাসিন্দা রাজনা বেগম বলেন, ‘ছুটি পাওয়ায় পরিবারের সবাই সাদাপাথর ঘুরতে এসেছি। জায়গাটা বেশ ভালো। কিন্তু নারীদের জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা রাখা হয়নি। বিশেষ করে ওয়াশরুম না থাকায় মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।’ এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে জানান তিনি।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাদাপাথরসহ সিলেটের কোনো পর্যটনকেন্দ্র নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এই শিল্পের বিকাশে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। যা রয়েছে তা কেবল কাগজে কলমেই।

‘সাদাপাথরে নৌকায় করে যাওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে। কারণ সেখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু মূল স্পটে পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নালার মতো করে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এখানে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিন্তু পর্যটকদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে না।’- ট্যুরিজম ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি মোহাম্মদ খতিবুর রহমান

ট্যুরিজম ডেভেলপার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি মোহাম্মদ খতিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সিলেটের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, সেটুকু স্থানীয় মানুষের হাত ধরেই হয়েছে। আর স্থানীয়রা তাদের ব্যবসার স্বার্থেই অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ করছেন। এতে স্থায়ীভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না।

‘সাদাপাথরে নৌকায় করে যাওয়ার পথ তৈরি করা হয়েছে। কারণ সেখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু মূল স্পটে পানি বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নালার মতো করে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। এখানে ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিন্তু পর্যটকদের স্বার্থ দেখা হচ্ছে না।’

খতিবুর রহমান বলেন, একজন পর্যটক দেশের অন্যপ্রান্ত থেকে যখন একটি পর্যটনকেন্দ্র দেখতে আসে, সে যাতে নিরাশ হয়ে না ফিরে সেজন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য রক্ষার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে কিছু বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যাতে করে পর্যটকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

আরও পড়ুন

পাঁচ সমস্যার সমাধান হলেই ঘুরে দাঁড়াবে সিলেটের পর্যটনশিল্প সিলেট ভ্রমণে ঘুরে আসুন লাল শাপলার লেকে সিলেটের জনপ্রিয় তিন স্পটে গিয়ে যা যা দেখবেন জাফলংয়ে ঝরনায় পর্যটকের পা কামড়ে ধরলো সাপ

সাদাপাথর পর্যটন বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সফাত উল্লাহ বলেন, সাদাপাথরে মূলত গোসল করার জন্য পর্যটকরা আসেন। কিন্তু পানি না থাকায় পর্যটকরা গোসল করতে পারেন না। এই মুহূর্তে উৎসমুখ খনন করা খুব প্রয়োজন।

সফাত উল্লাহ আরও বলেন, কয়েক বছর আগে সরকারিভাবে একটি গণশৌচাগার করা হয়েছিল। কিন্তু বন্যার কারণে সেটি ভেঙে যাওয়ার পর নতুন করে এটি নির্মাণ করা হয়নি।

এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবিদা সুলতানা বলেন, ‘পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে সাদাপাথরের উন্নয়নে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বাউন্ডারি দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে কে বা কারা এটি ভেঙে ফেলেছে। যার কারণে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। নতুন করে পরিকল্পনা মাফিক কাজ শুরু করা হবে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়ে গেলে সাদাপাথরের অনেক উন্নয়ন হবে।’

ইউএনও আরও বলেন, ‘উৎসমুখ বন্ধের বিষয়টি আমার জানা নেই। শুকনো মৌসুমে পানি কমে যায়। তবে নৌকার পথ স্বভাবিক রয়েছে। তারপরও আমি পরিদর্শন করে কী করণীয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেব।’

এমএমএআর/এমএস