ভ্রমণ

পর্যটনে অপার সম্ভাবনা, সমস্যা অনেক

ঢাকার খিলগাঁওয়ের সি ব্লকের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন (৪২)। মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনারত অবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ভ্রমণে বের হতেন। এখন সংসার জীবনে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বছরে অন্তত দুবার ভ্রমণে যান বিদেশে। দেশের কোনো পর্যটন কেন্দ্র তাদের টানে না। কারণ শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন!

Advertisement

আলাপকালে ইকবাল হোসেন জানান, দেশের পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন তার পছন্দের জায়গা ছিল। ২০১৪ সালে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে বেড়াতে গেলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তাদের সঙ্গে থাকা সব টাকা, স্বর্ণালংকার লুটে নেন ছিনতাইকারীরা। ওই আতঙ্ক এখনো তাদের তারা করে বেড়ায়। তাই আর কখনো কক্সবাজার যাননি। এখন সময় পেলেই পরিবার নিয়ে বিদেশে যান।

ধানমন্ডির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আসলাম তালুকদার। গত ১৩ ডিসেম্বর একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার বেড়াতে যান। কিন্তু কক্সবাজার গিয়ে পড়েন বিপাকে। ভালো মানের কোনো হোটেলে রুম খালি নেই। রুম খুঁজতে গিয়ে চার ঘণ্টা এদিক-সেদিক ঘুরতে হয়েছে। আবার বিচে হকার, ভিক্ষুকের উৎপাত।

আসলাম তালুকদার বলেন, ‘সম্প্রতি ছেলের স্কুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এরপর পরিবার নিয়ে ভ্রমণে যাই। কিন্তু শান্তিতে আর বেড়াতে পারলাম না। এখন ধারণক্ষমতার বাইরে লোকজন কক্সবাজার যায়। বিচে গেলে মনে হবে কোনো মাছ বাজারে গেছি। সাগরের পাড়ে স্বস্তিতে বসা যায় না। হকার, পথশিশু, ভিক্ষুকের উৎপাত বেড়েছে। এর সঙ্গে মশার উপদ্রব সীমাহীন। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।’

Advertisement

পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সমন্বয়হীনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়নের অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না দেশের পর্যটন শিল্প। এই খাতে অবকাঠামো, প্রয়োজনীয় প্রচারণা, উন্নত সেবাদানে দক্ষতার অভাব, পর্যটকদের অতিরিক্ত খরচসহ দুর্বল ব্যবস্থাপনা প্রকট। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে পশ্চিমা পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশে পর্যটন বলতে আমরা শুধু কক্সবাজারকে বুঝি। কিন্তু এখন কক্সবাজারে হাঁটাচলার জায়গা নেই। ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিনে যা দেখেছি, এখন আর তা নেই। সেখানেও হাঁটার জায়গা নেই। খালি হোটেল আর হোটেল। এই অব্যবস্থাপনার জন্য মূলত সরকারই দায়ী।- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প অনেক শক্তিশালী। সেখানে সারা বছরই পশ্চিমা পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। অথচ বাংলাদেশ উদীয়মান শিল্পের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটন শিল্প। এই শিল্প থেকে মোট জিডিপির শতকরা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসে। এখন শিল্পটি কাজে লাগিয়ে দেশের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয়ের সুযোগ আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পর্যটন বলতে আমরা শুধু কক্সবাজারকে বুঝি। কিন্তু এখন কক্সবাজারে হাঁটাচলার জায়গা নেই। ১০ বছর আগে সেন্টমার্টিনে যা দেখেছি, এখন আর তা নেই। সেখানেও হাঁটার জায়গা নেই। খালি হোটেল আর হোটেল। এই অব্যবস্থাপনার জন্য মূলত সরকারই দায়ী।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘ট্যুরিজমের সঙ্গে বিশ্বের ১০ শতাংশ মানুষ জড়িত। এটা একটা বিশাল বড় শিল্প। এখানে বাংলাদেশ সরকার ও ব্যবসায়ীদের কারণীয় আছে। ট্যুরিজম বা ভ্রমণ মানেই সব কক্সবাজার নয়। এখন কক্সবাজার ধারণক্ষমতার বাইরে লোক যায়। রুম না পেয়ে মানুষ হোটেলের লবিতে বিছানা করে থাকে। এ থেকে বের হতে হবে। অথচ কক্সবাজারের মতোই কুয়াকাটার পরিবেশ। সেখানে অবকাঠামো উন্নয়ন নেই।’

আরও পড়ুনপরিকল্পনার অভাবে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পে ক্ষতির আশঙ্কা

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এর বাইরে সুন্দরবনও ভ্রমণের জন্য সুন্দর জায়গা। এমন গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। যাতে মানুষ যে উদ্দেশ্যে ভ্রমণে যায়, অর্থাৎ ঢাকার কর্মব্যস্ত নগর থেকে একটু রিলাক্সের জন্য যারা যায়, তারা যেন তা পায়। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এটা নিশ্চিত করা সম্ভব।’

বাংলাদেশের পর্যটন

নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্য, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে টানে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, বিস্তৃত হাওরাঞ্চল, বিশাল পার্বত্যাঞ্চল, মহাস্থানগড় এবং পাহাড়পুরের হাজার বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে বাংলাদেশে, যা একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকর্ষণ করবে। কিন্তু এরপরও সেভাবে এগোতে পারছে না দেশের পর্যটন খাত।

দেশে পর্যটন শিল্পের বহুবিধ সম্ভাবনা রয়েছে’

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ উদীয়মান শিল্পের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যটন শিল্প। এই শিল্প থেকে মোট জিডিপির শতকরা ৪ দশমিক ৪ শতাংশ আসে। শিল্পটি কাজে লাগিয়ে দেশের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে ট্যুরিজম বোর্ড একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শিগগির তা চূড়ান্ত করা হবে।

যদিও ২০২০ সালের জানুয়ারিতে এই মহাপরিকল্পনার কাজ হাতে দেয় ট্যুরিজম বোর্ড। এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনার খসড়া চূড়ান্ত করতে পারেনি সংস্থাটি। অথচ ৩০ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার ব্যয় করছে ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

পর্যটন খাতের অংশীজনরা জানান, পর্যটন কাঠামোর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। আবার এশিয়ার মধ্যে শুধু পাকিস্তান ছাড়া বাকি সব দেশ থেকেই পিছিয়ে বাংলাদেশ। এর প্রধান কারণ দেশের পর্যটন শিল্পের অবকাঠামোগত দুর্বলতা। সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয়। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। নেই পর্যাপ্ত হোটেলের সুব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রগুলোও অবহেলিত।

আরও পড়ুন

চূড়ান্ত হয়নি মহাপরিকল্পনা, ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না পর্যটন খাত

এছাড়া বিশ্বে পর্যটনের পরিচিতি নেই বললেই চলে। এর বাইরে পর্যটকের নিরাপত্তার অভাব, উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব, বিদেশি পর্যটকের অভাব, অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে আকাশপথে সব গন্তব্যে যাওয়ার সুযোগ না থাকা পিছিয়ে পড়ার কারণ।

পর্যটন বিকাশে বাধা বা সমস্যা

দেশে সাগর, পাহাড়, হাওরের সৌন্দর্য, প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসহ কম-বেশি সাত-আটশ দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ দিতে সম্মুখীন হতে হচ্ছে নানারকম প্রতিকূলতার। অবকাঠামো, মানসম্মত রাস্তা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সমন্বয়হীনতা, দক্ষ জনবলের অভাব, বাজেটের ঘাটতিসহ রয়েছে অনেক সমস্যা। ফলে বিদেশি পর্যটকরা আমাদের পর্যটন শিল্পের প্রতি আকর্ষিত তো হচ্ছেই না বরং দেশের পর্যটকরা অবসর সময় কাটাতে চলে যাচ্ছেন বিদেশে।

জিডিপিতে পর্যটন শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামোগত দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। গত এক যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও এখনো রয়েছে অনেক দুর্বলতা। নেই পর্যাপ্ত হোটেলের সুব্যবস্থা। পর্যটনকেন্দ্রগুলো অবহেলিত। এগুলোর সুপরিকল্পিত আধুনিকায়ন ও শুল্কমুক্ত বিপণির অভাবও এক্ষেত্রে বড় বাধা।

দেশি বা বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুরক্ষা ব্যবস্থা অনেক বড় একটি ইস্যু। বেড়াতে গিয়ে অনেক পর্যটক চুরি, ছিনতাই, হত্যা, রাহাজানি, সহিংসতার কবলে পড়ছেন। অথচ পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের নির্বিঘ্নে চলাফেরার নিশ্চয়তা দেওয়ার কথা।

তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পর্যটনের ব্যয়ও বেশি। কিন্তু সেই অনুপাতে অন্য সুযোগ-সুবিধা কম। যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে আবাসিক হোটেলগুলোতে ভাড়া অনেক বেশি। যেমন কক্সবাজারে থ্রি বা ফোর স্টার হোটেলে এক রাত থাকতে গেলেই গুনতে হয় আট থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার ফাইভ স্টার হোটেলের ভাড়া ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, যা পর্যটকদের জন্য অনেক বড় একটি প্রতিবন্ধকতা। এর চেয়ে কম ব্যয়ে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপ।

বাংলাদেশের পর্যটকের প্রায় বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। মাত্র ৫ শতাংশ পর্যটক ইউএসএ থেকে এলেও বেশির ভাগই প্রবাসী বাঙালি। অথচ বিশ্বব্যাপী পর্যটন বাজারের ৫৩ শতাংশ আসে আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে, যা থেকে বাংলাদেশ অনেকটাই বঞ্চিত।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২২ সালে আমাদের দেশে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার বিদেশি পর্যটক আসে। ২০২৩ সালে আসছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। এ পর্যটকদের অধিকাংশই ভারতের। আবার তাদের মধ্যে প্রবাসী বাঙালিও আছেন।

দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যারা বেড়াতে যান, তাদের কেউ কেউ অংশীজনদের কাছে হেনস্তার শিকার হন। এর মূল কারণ দক্ষ, মার্জিত জনবলের অভাব, যা এই শিল্পের বিকাশে একটা বড় সমস্যা। একই সঙ্গে রয়েছে উন্নত ও দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থার অভাব। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় না প্রয়োজনীয় তেমন কোনো তথ্য।

ট্যুর অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) ও কক্সবাজার ট্যুরিস্ট ক্লাবের সভাপতি মো. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘পর্যটনে বড় সমস্যা সমন্বয়ের অভাব। একটি পর্যটন এলাকায় সরকারের ট্যুরিজম বোর্ড, পর্যটন করপোরেশন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, সিটি করপোরেশন বা নগর কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কাজ রয়েছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং পরে সীমিত পর্যটক ভ্রমণের অনুমতি নিয়ে যা হয়েছে, তা পর্যটকদের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ পর্যটন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই যদি সেন্ট মার্টিন নিয়ে সরকার স্পষ্ট বার্তা দিতো, তাহলে ভোগান্তি হতো না।’

কক্সবাজারকেন্দ্রিক ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে টুয়াক সভাপতি বলেন, ‘কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত রয়েছে। এর যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ করা হলে শহরকেন্দ্রিক ট্যুরিস্টের চাপ কমবে। আর কক্সবাজার বিমানবন্দর আধুনিকায়নের কাজ এখন দৃশ্যমান। এ বিমানবন্দরের কাজ শেষ হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সৈকতে নামার আলাদা জায়গা করে দিলে বিদেশি ট্যুরিস্ট আরও বাড়বে।’

ঢাকার শাহজাদপুরে ট্রাভেল এক্সপার্ট অ্যাভিয়েশন সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন। প্রায় একযুগ ধরে এই ব্যবসা করেন তিনি। আলাপকালে আলমগীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতে বড় সমস্যা আকাশপথে ভাড়া বৃদ্ধি। যে যার মতো করে পর্যটকদের জিম্মি করছেন। ফলে দেশের পর্যটক বিদেশমুখী হচ্ছে। একজন পর্যটক আকাশপথে কক্সবাজার যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, ঘোরাঘুরি করতে যে টাকা খরচ করেন, দ্বিগুণ টাকা খরচ করলে ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল ভ্রমণ করা সম্ভব।’

বিদ্যমান পর্যটন ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা আছে। পর্যটন এলাকাগুলোতে আমরা কোনো ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারিনি। কত পর্যটক যাবে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। যেখানে এক হাজার পর্যটক যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে, সেখানে ২০ হাজার যাচ্ছে। এটা তো সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস।- বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদ্যমান পর্যটন ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যা আছে। পর্যটন এলাকাগুলোতে আমরা কোনো ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করতে পারিনি। কত পর্যটক যাবে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। যেখানে এক হাজার পর্যটক যাওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে, সেখানে ২০ হাজার যাচ্ছে। এটা তো সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস। এছাড়া আমাদের পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা কম। যেমন খাবার, থাকার ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল, যা পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এটা অন্যতম বড় সমস্যা।’

পর্যটন এলাকায় যাতায়াতে রাস্তাঘাট খুব মানসম্মত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা ভ্রমণে যেতে যেতে কোমরে ব্যথা অনুভব করেন। পৃথিবীর অনেক দেশে এরকম না। উন্নত দেশে হাজার মাইল ভ্রমণ করলেও টের পাওয়া যায় না।’

পর্যটনে সম্ভাবনা

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন শুরু করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এজন্য বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তি করে বোর্ড। ২০২৩ সালের জুনে এই পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হয়। পরে তা জাতীয় পর্যটন পরিষদে পাঠায় ট্যুরিজম বোর্ড। এখন পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পনাটি পর্যালোচনা চলছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি তা চূড়ান্ত হতে পারে।

এই খসড়া মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য পর্যটনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এজন্য ক্রমাগত পর্যটন খাত কীভাবে বিকশিত হবে, তার রোডম্যাপ হলো এই মাস্টারপ্ল্যান। এর ভেতরে প্রত্যেক বিভাগভিত্তিক রিজিওনাল প্ল্যানও রয়েছে। এখানে মার্কেটিং, ইনভেস্টমেন্ট এবং অ্যাকশন প্ল্যানও আছে। এছাড়া মহাপরিকল্পনায় মোট ৫৩টি ক্লাস্টার রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি অগ্রাধিকার ক্লাস্টার। যেমন– শ্রীমঙ্গল এবং তার আশপাশে যতগুলো অ্যাট্রাকশন আছে তার সবগুলো মিলে একটি ক্লাস্টার। এর বাইরে অন-অ্যারাইভাল (আগমন) ভিসার জন্য যোগ্য পর্যটকদের সুবিধার্থে একটি ই-ভিসা সিস্টেম উন্নয়ন রয়েছে।

এর বাইরে মহাপরিকল্পনায় পর্যটক আকর্ষণের জন্য হেলিপোর্ট নির্মাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং আবাসন সুবিধা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রকমের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটন সেবার মান বৃদ্ধি, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক আকর্ষণগুলোর প্রচার, পর্যটকদের জন্য নিরাপদ, অতিথিপরায়ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সাল নাগাদ ৫৫ লাখ বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, ‘আমাদের আবাসন ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা, খাবার, পর্যটন এলাকার মানুষের আচরণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, পর্যটন এলাকার মানুষ পর্যটকদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছেন, তাদের সহযোগিতা করছে কি না এমন অনেক বিষয় কিন্তু পর্যটন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। আমি মনে করি পর্যটন বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ট্যুরিজম বোর্ড, পর্যটন করপোরেশন কাজ করলেই হবে না, সবাইকে এই খাতের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।’

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম