প্রবাস

শীতার্ত পথশিশুদের জীবনযুদ্ধে আমাদের করণীয়

মানুষের প্রথম চাহিদাগুলো ছিল শারীরিক অস্তিত্ব নিশ্চিত করা। অন্ন, খাদ্য, বস্ত্র, পোশাক, বাসস্থান বা থাকার জায়গা—এগুলো একটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অনেকেই একে মৌলিক চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করে, তা কখনোই স্থির থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তার চাহিদা আরও উন্নত করার চেষ্টা করে—মানুষ খেতে চায় পুষ্টিকর খাবার, পরতে চায় ডিজাইন এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন অনুযায়ী পোশাক এবং বাসস্থানের ক্ষেত্রে তেমন আধুনিক বা বিলাসবহুল বাড়ি, যেখানে সব আধুনিক সুবিধা থাকবে।

Advertisement

চিকিৎসা এবং শিক্ষা মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জ্ঞান অর্জন—এ দুইই মানুষের আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের একদিকে যেমন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং জ্ঞান অর্জনের দিকে আগ্রহী, অন্যদিকে তাদের আরও উন্নত প্রযুক্তি, ভ্রমণ সুবিধা এবং দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহও রয়েছে।

চাহিদার এই পরিবর্তন সমাজের কাঠামোকে পরিবর্তন করেছে। মানুষ এখন বেশি স্বাধীনতা, তথ্য, বিনোদন এবং অর্থ লাভের পেছনে ছুটছে। সামাজিক স্তরের মধ্যে পরিবর্তন আসছে, কারণ একটি সময়ের আগে যখন কিছু নির্দিষ্ট ধনী শ্রেণির লোকেরা তাদের অতিরিক্ত চাহিদা পূর্ণ করতে পারত, বর্তমানে মধ্যবিত্ত এবং নিচু শ্রেণির লোকেদেরও উচ্চতর চাহিদা থাকতে শুরু করেছে। নতুন প্রযুক্তির প্রভাবে অর্থনৈতিক সমতা, সমাজতান্ত্রিক শাসন এবং বিনোদনমূলক প্রোডাক্টস এই চাহিদার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠেছে। ঠিক তেমন একটি সময়ে বাংলাদেশের অনেক মানুষ শীতের তীব্রতায় কষ্ট পাচ্ছে।

যদিও শীত বিশ্বের অনেক দেশের জন্য একটি কঠিন সময় তবে বাংলাদেশে শীতকাল প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য নিয়ে আসে কিন্তু বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি চরম কষ্টের সময়। বিশেষ করে ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শীতকালের দিনগুলো কেবল বেঁচে থাকার লড়াই। তাদের এই দুর্দশা এবং এ সমস্যা সমাধানে সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকা ও আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের অভাব নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ।

Advertisement

শীতের কষ্টে হতদরিদ্র মানুষের জীবন: করুণ বাস্তবতাবাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে হাজার হাজার পথশিশু এবং দরিদ্র পরিবার শীতকালে মানবেতর জীবনযাপন করে। ফুটপাত, রেলস্টেশন বা উন্মুক্ত আকাশের নিচে শুয়ে থাকা শিশুরা ছেঁড়া কাপড়ে ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করে। কমলাপুর রেলস্টেশনে কিংবা ঢাকার অন্যান্য অংশে তাদের আর্তনাদ আমাদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে। এদের অধিকাংশই শীতকালে খাদ্য, চিকিৎসা এবং বস্ত্রের অভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়। তাদের জন্য শীতকালের প্রতিটি দিন একটি যুদ্ধ, যেখানে বেঁচে থাকা একমাত্র লক্ষ্য।

‘প্রার্থী’ কবিতার বাস্তবতা এবং প্রাসঙ্গিকতাসুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রার্থী’ কবিতায় দরিদ্র মানুষের কষ্টের চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি নিম্নবিত্ত মানুষের কষ্ট এবং সূর্যের উত্তাপের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে তুলে ধরেছিলেন, সে বহু বছর আগের কথা, অথচ আজও তা প্রাণবন্ত।

‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে উত্তাপ আর আলো দিও।’

Advertisement

এটি কেবল একটি কাব্যিক আবেদন নয় বরং সমাজের উচ্চবিত্তদের প্রতি একটি আহ্বান। কবির মতো আমরাও চাই সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষরা দরিদ্রদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক।

আরও পড়ুন: গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশ

আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই?আমরা এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই না যেখানে শীত এলে সমাজের এলিট গ্রুপ তাদের অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করবে রাস্তায় শিশুদের কম্বল, কাঁথা বিলিয়ে। আমরা চাই সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হোক। আমরা দেখতে চাই, সব শিশুই যেন সম্মানজনক শিক্ষা পায় এবং সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ কল্পনা করি, যেখানে শীতকাল কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় হবে।

আমরা এমন একটি দেশ চাই, যেখানে প্রতিটি শিশুর শিক্ষা ও সম্মানের জীবনযাপনের অধিকার থাকবে। তারা যেন কেবল দান-অনুদানের ওপর নির্ভর না করে বরং সমাজের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের উন্নয়নের পথ তৈরি করতে পারে।

দুর্দশা নিরসনে এখনই কী করণীয়দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘব করতে কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

১. শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি:শীতকালে দরিদ্র মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ একটি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। গ্রামাঞ্চল এবং প্রত্যন্ত এলাকায় এই উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে।

২. অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন:শীতকালে ছিন্নমূল মানুষের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত। সেখানে তাদের জন্য গরম খাবার, শীতবস্ত্র এবং চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. স্বাস্থ্যসেবা:ঠান্ডাজনিত অসুখ ও নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব রোধে মোবাইল মেডিকেল টিমের মাধ্যমে সেবা দিতে হবে।

৪. সচেতনতা বৃদ্ধি:সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা জাগাতে মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালানো জরুরি।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য কর্মসংস্থান এবং শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সমাজের দায়িত্ব এবং পাচার অর্থের ব্যবহার অর্থ পাচার বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি বড় বাধা। পাচার অর্থ উদ্ধারের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন:

• আইনি কাঠামো শক্তিশালীকরণ: অর্থ পাচার রোধে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মানি লন্ডারিং আইন কার্যকর করা।

• প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি: পাচার লেনদেন চিহ্নিত করতে ডেটা অ্যানালাইটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার।

• আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পাচার অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক চুক্তি করা।

• উদ্ধার অর্থের সঠিক ব্যবহার: এই অর্থ দিয়ে পথশিশু পুনর্বাসন, শীতবস্ত্র বিতরণ এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

একজন মানুষের ভালো কাজ সমাজের অন্যদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি চেইন রিঅ্যাকশনের মতো কাজ করে, যা সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে।

ভালো থাকা মানে নিজের শক্তি বাড়ানো। এটি আমাদের মনের স্থিতি বাড়ায় এবং আত্মার গভীরতা তৈরি করে। অতএব যে ভালো থাকতে জানে, সে ভালো রাখতে জানে।

আমি নিজেও কনকনে শীতের দেশে বসবাস করি, মাঝে মধ্যে শীতের কষ্ট আমিও অনুভব করি। শীতে ভালো আছি। আমি মনে করি ভালো থাকা একটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব। ভালো থাকা কেবল নিজের জন্য নয়, এটি সমাজের প্রতি একটি দায়িত্ব। কারণ আপনার ভালো থাকা অন্যদের ভালো থাকার অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে।

আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে শীতকালে কোনো শিশু খালি পায়ে থাকবে না এবং কোনো মা তার সন্তানকে ঠান্ডায় বাঁচানোর জন্য নিরূপায় হবে না। আমরা চাই, শীত কেবল কবি বেগম সুফিয়া কামালের ‘পল্লী স্মৃতি’ কবিতার ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশীতে বিষম খেয়ে, আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে’ গল্পের বিষয় হয়ে থাকুক।

সুকান্তের কবিতার মতো আমিও বলতে চাই,

‘হে দুর্নীতি তুমি নিপাত যাও, আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে শীতকালেও প্রতিটি শিশুর মুখে থাকবে হাসি, আর শীত হবে আনন্দের উৎস।’

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম