বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ফেনীর মহিপালে ৪ আগস্ট সমাবেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গুলিবর্ষণে ৯ জন নিহত হন। মুহুর্মুহু গুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মহিপাল এলাকা। আন্দোলনের সহযোদ্ধারা আহত ও নিহতের নিয়ে যান ফেনী জেনারেল হাসপাতালে। সেদিন হাসপাতালে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
Advertisement
হাসপাতাল সূত্র জানায়, সেদিন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সব ডাক্তার নেমে এসেছিলেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও উপপরিচালক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজী, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আসিফ ইকবাল, সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি ডা. কামরুজ্জামান, রেসিডেন্স সার্জন ডা. আদনান আহমেদ, মেডিকেল অফিসার ডা. শহিদুল্লাহ, ডা. সাইদুর রহমান, ডা. রফিকুল ইসলাম, ডা. নাজমুল হাসান সাম্মিসহ আরও অনেক চিকিৎসক। এছাড়া সিনিয়র স্টাফ নার্স আলো রাণী নাথ, সাজ্জাদ হোসেন, মো. তারিকুজ্জামানসহ ৫০ থেকে ৬০ জন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত হন সেদিন।
ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. তরিকুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট আমরা সকালে ডিউটিতে ছিলাম। আমি, সাজ্জাদ ও আলো দিদি। বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার দিকে হঠাৎ রোগী আসা শুরু করলো। যেগুলো ছিল গানশট ইনজুরি। আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম গন্ডগোল পর্যায়ের কিছু রোগী। কিন্তু এরপর থেকে আসা শুরু করলো সব স্টুডেন্ট। গোটা জরুরি বিভাগের চেহারা পাল্টে গেছে। ইমার্জেন্সিতে শুধু রক্ত আর রক্ত। কেউ নিয়ে আসছে ডেড বডি, কেউ নিয়ে আসছে আহতদের। এখানে পা ফেলার জায়গা ছিল না। যে যেভাবে পেরেছি সেবা দিয়েছি। সব ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ডাক্তাররা ছুটে এসেছিলেন, সিনিয়র নার্স, ওয়ার্ড থেকে হেল্পিং নার্সরা এসেছিলেন সেবা দিতে। সবাই মিলেই সেবা দিয়েছি।’
সিনিয়র স্টাফ নার্স সুচিত্রা রাণী বণিক বলেন, ‘৪ আগস্ট আমার রাতে ডিউটি ছিল। সহকর্মী তরিক ফোন করলে আমি ছুটে আসি। এসে দেখি রক্তের বন্যা। আহতদের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসছে। পরে আমরা সেবা দিলাম। এত রক্ত আর কোনোদিন দেখিনি। রিকশা-সিএনজি অটোরিকশা সবকিছুতে শুধু আহত আর নিহত। আমার জীবনে একসঙ্গে এত মরদেহ ও রক্ত আর কখনো দেখিনি।’
Advertisement
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার নাজমুল হক সাম্মি বলেন, ‘৪ আগস্ট ছিল পীড়াদায়ক। আমরা ডাক্তার হিসেবে এ অবস্থা ফেইস করেছি। কী বিপজ্জনক অবস্থা ছিল ইমারজেন্সি রুমের। ঠিক দুপুরে খবর এলো গুলিবিদ্ধ কিছু রোগী আসছে, সবাই প্রস্তুত হয়ে যান। নার্স-ডাক্তার যে যেভাবে ছিলেন সবাই প্রস্তুত হয়ে থাকেন। আমরা প্রস্তুত হলাম। দুপুর একটার দিকে একটার পর একটা রোগী আসতে লাগলো। প্রতিটি রোগীর ক্রিটিক্যাল অবস্থা। বিশেষ করে ব্লিডিং বেশি ছিল বলে আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। কীভাবে ওদের ম্যানেজ করবো। আমরা সাপোর্ট দিচ্ছিলাম। কারণ ডাক্তারের কাছে রোগী বড় ব্যাপার। কোনো কারণে যখন রোগী সারভাইভ করে না তখন আরও বেশি কষ্ট লাগে। স্টাফ যারা ছিলেন আমরা ফেস করেছি সময়টা। এজন্য দক্ষতা ও মনোভাব শক্ত রেখে আমরা টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করেছি। নিহতরা অপরিচিত ছিল, যারা নিয়ে এসেছিল তারাও নাম ঠিকানা বলতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর আত্মীয়-স্বজন এসে মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করে।’
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. আসিফ ইকবাল বলেন, ‘দুপুর দুইটা থেকে আড়াইটার দিকে বাড়ি ফিরে যাবো, এ ধরনের একটা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শুনে আমরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আহত, নিহত অনেক রোগী দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। এগুলো দেখে আমাদের কর্মীরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এরকম ঘটনা আমাদের লাইফে আর কখনো দেখিনি। বিকেল তিনটা থেকে আহত রোগীর সঙ্গে মরদেহ আসছিল। মনে হলো যেন মরদেহের মিছিল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। চিকিৎসা করায় আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। নিহতদের মরদেহগুলো মর্গে রাখি। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এমন অবস্থা ছিল যে মর্গের সামনে থেকে মরদেহ নিয়ে গেছে। আমাদের কিছু করার ছিল না। আহত প্রায় ১৫০ এর ওপরে, নিহত ৮ জন ছাড়াও আরও হতে পারে। জরুরি বিভাগে মেডিকেল অফিসার ও ইনচার্জ সার্জারি ডাক্তার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কারো চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।’
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক উপ-পরিচালক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজী বলেন, ‘৪ আগস্ট স্মরণকালের ভয়াবহ ক্যাজুয়ালিটি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ফেনীতে যে ভয়াবহ সংঘাত হয়েছে সে সংঘাতে আমরা আঁচ করতে পেরেছিলাম। খবর পেয়েছিলাম ট্রাংক রোড থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল মহিপালের দিকে যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের হটানোর জন্য। তাৎক্ষণিক ক্যাজুয়ালিটির সঙ্গে যেসব বিভাগ জড়িত সার্জারি ও অর্থোপেডিক বিভাগকে সতর্ক করে দিই। সবাইকে তাৎক্ষণিক প্রস্তুতির নির্দেশ দিই। কর্মরত নার্সের বাইরে যারা ক্যাম্পাসে ছিল, বাইরে ছিল, চতুর্থ শ্রেণি ও সিকিউরিটি গার্ড সবাই মিলে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত হই। আমরা দেখতে থাকি যেভাবে আহত ও নিহত একটার পর একটা আসছিল আর রক্ত গঙ্গা বয়ে যাচ্ছিল। রিকশা ও পথে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছিল। আমরা সবাই মিলেমিশে চেষ্টা করেছি। প্রাথমিক চিকিৎসা যেগুলো দেওয়া দরকার ছিল দিয়েছি, ভর্তি দরকার ছিল তাদের ভর্তি করেছি। যাদেরকে রেফার করা দরকার, তাদের সেখানে পাঠিয়েছে। ওইদিন সবাই আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। এমন একটি পরিবেশ ছিল যে অনেকে তাদের নাম ঠিকানা বলতেও অনীহা প্রকাশ করেছে। তারা চিকিৎসা নিতে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু মারাত্মক আতঙ্ক কাজ করছিল। তারা হয়ত ভাবছিল পরবর্তীতে তাদের পরিবারের কী হবে? পরদিন সরকার পতন না হলে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো অথবা বড় ধরনের আঘাত তাদের ওপর আসতো। এজন্য চিকিৎসা নিতে এসে তারা পরিচয় ও ঠিকানা দেয়নি। অনেকেই অজ্ঞাত ছিল। আমরা রিসিভ করেছি। অনেক অজ্ঞাতকে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। যারা নিয়ে এসেছিল তারাও নাম ঠিকানা বলতে পারছিল না। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ৫০-৬০ জন আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি ওইদিন।’
গত ৪ আগস্ট ফেনীর মহিপাল এলাকায় উড়ালসেতুর নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলা, গুলি, ককটেল বিস্ফোরণ শেষে পিটিয়ে ও কুপিয়ে শতাধিক ছাত্র জনতাকে আহত করে। ওইদিনই সেখানে হামলার ঘটনায় ৮ জন নিহত হন এবং পরে একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের স্বজনদের পক্ষ থেকে ফেনী মডেল থানায় ৮টি হত্যা মামলা দায়ের এবং আহতদের পক্ষ থেকে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের তালিকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ফেনীর সদ্য তিন সাবেক সংসদ সদস্যসহ জেলার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নাম রয়েছে।
Advertisement
এফএ/জিকেএস