‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্য হিসেবে গড়ে তোলা’ বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান লক্ষ্য। অথচ প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরে একটি মহাপরিকল্পনাই দাঁড় করাতে পারেনি সংস্থাটি। পাঁচ বছর আগে একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও চূড়ান্ত হয়নি এখনো। কিছু নীতি না মেলায় অন্তর্বর্তী সরকার এসে মহাপরিকল্পনার খসড়াটি আবার পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
Advertisement
দীর্ঘ সময় ধরে একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করতে পারায় অপার সম্ভাবনার পর্যটন খাত বারবার হোঁচট খাচ্ছে। অব্যবস্থাপনা আর সমন্বয়হীনতায় কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না দেশের পর্যটন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, অনেক অসঙ্গতি নিয়েই মহাপরিকল্পনার খসড়াটি চূড়ান্ত হওয়ার পথে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গাফিলতির কারণে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ পর্যটন সম্ভাবনাময় দেশে আকৃষ্ট হচ্ছে না বিদেশি পর্যটকরা। একই সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দেশের পর্যটকরাও। পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, পর্যটন খাতে অব্যবস্থাপনা তত বাড়বে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছিল জাতীয় পর্যটন পরিষদ। সে অনুযায়ী এখন পর্যালোচনার কাজ চলছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তা শেষ হবে।-বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের
Advertisement
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের দাবি, সুপরিকল্পিত পর্যটন বিকাশে এ খাতের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনার খসড়া প্রায় চূড়ান্ত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পরিকল্পনা চূড়ান্তে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে তিনি ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়ার পর ঘটে বিপত্তি। এখন বিভিন্ন অসঙ্গতি ধরে (ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও টুঙ্গিপাড়া প্রকল্প বাদ এবং শেখ পরিবারের নামে করা বেশ কিছু স্থাপনার নাম পরিবর্তন ইত্যাদি) এই মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনার নির্দেশনা দিয়েছে জাতীয় পর্যটন পরিষদ। সে অনুযায়ী এখন পুরো মহাপরিকল্পনাটি ফের পর্যালোচনা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দেশের পর্যটনে আমূল পরিবর্তন আসবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনার পরামর্শ দিয়েছিল জাতীয় পর্যটন পরিষদ। সে অনুযায়ী এখন পর্যালোচনার কাজ চলছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তা শেষ হবে।’
জাতীয় পর্যটন পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী খসড়া মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা চলছে। পরবর্তী পর্যটন সভায় তা চূড়ান্ত করতে উপস্থাপন করা হবে। আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এই সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে।- বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক মো. মাজহারুল ইসলাম
তিনি বলেন, ‘মহাপরিকল্পনায় আমরা সারাদেশকে ৫১টি ক্লাস্টারে ভাগ করেছি।এর মধ্যে ধানমন্ডি-৩২ ও টুঙ্গিপাড়াও ছিল। এখন এ বিষয়গুলোতে জায়গায় জায়গায় আমরা কিছু পরিবর্তন করছি। অর্থাৎ মহাপরিকল্পনায় এমন কিছু করা যাবে না যেটা বর্তমান সরকারের নীতির পরিপন্থি।’
Advertisement
২০২০ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন শুরু করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। এজন্য বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে চুক্তি করে বোর্ড। চুক্তিমূল্য প্রায় ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এই চুক্তি অনুযায়ী, ওই বছরের জুনে তা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে টানা দুই বছর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি আইপিই গ্লোবাল। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই পরিকল্পনার চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। এই সময়ের মধ্যে তারা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করে জাতীয় পর্যটন পরিষদে পাঠায়।
দেশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। এখন এই মহাপরিকল্পনা কীসের ভিত্তিতে করা হচ্ছে, তা ট্যুরিজম বোর্ডই বলতে পারবে। তবে পর্যটন মহাপরিকল্পনা তৈরির শুরু থেকে খামখেয়ালি করেছে ট্যুরিজম বোর্ড। ফলে বারবার এই পরিকল্পনার খসড়া তৈরিতে দেরি হয়েছে।- টোয়াব পরিচালক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) মোহাম্মাদ ইউনুছ
আরও পড়ুন পরিকল্পনার অভাবে সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পে ক্ষতির আশঙ্কা সন্দ্বীপে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা পর্যটন জমাতে কক্সবাজারে নানা আয়োজন পর্যটন শিল্পের উন্নতিতে যা করা জরুরিট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় পর্যটন পরিষদের সভায় এই মহাপরিকল্পনা চূড়ান্তে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। পরে তা পাঠানো হয় জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলে (এনটিসি)। এই কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২০ আগস্ট তার সভাপতিত্বে এনটিসির একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এজন্য মহাপরিকল্পনাটি চূড়ান্ত হয়নি।
ট্যুরিজম বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর পর্যটন মহাপরিকল্পনায় বেশ কিছু পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়েছে পর্যটন পরিষদ। এর মধ্যে সম্প্রতি ট্যুরিজম বোর্ড পরিদর্শন করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। তিনিও খসড়া মহাপরিকল্পনায় কয়েকটি বিষয় পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও টুঙ্গিপাড়াকেন্দ্রিক প্রকল্প বাতিল এবং বেশ কিছু স্থাপনার নাম পরিবর্তনের কাজ চলছে। তবে ঠিক কবে চূড়ান্ত ঘোষণা করা হবে, তা কেউ সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘জাতীয় পর্যটন পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী খসড়া মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা চলছে। পরবর্তী পর্যটন সভায় তা চূড়ান্ত করতে উপস্থাপন করা হবে। আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে এ সভা অনুষ্ঠিত হতে পারে।’
খসড়া মহাপরিকল্পনায় যা আছেট্যুরিজম বোর্ড সূত্র জানায়, পর্যটন মহাপরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এজন্য ক্রমাগত পর্যটন খাত কীভাবে বিকশিত হবে তার রোডম্যাপ হলো এই মাস্টারপ্ল্যান। এর ভেতরে প্রত্যেক বিভাগভিত্তিক রিজিওনাল প্ল্যানও রয়েছে। এখানে মার্কেটিং, ইনভেস্টমেন্ট এবং অ্যাকশন প্ল্যানও রয়েছে। এছাড়া মহাপরিকল্পনায় রয়েছে মোট ৫৩টি ক্লাস্টার। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ক্লাস্টার ১৯টি। যেমন– শ্রীমঙ্গল ও তার আশপাশে যতগুলো আকর্ষণ আছে এর সবগুলো মিলে একটি ক্লাস্টার। এর বাইরে অন-অ্যারাইভাল (আগমন) ভিসার জন্য যোগ্য পর্যটকদের সুবিধার্থে একটি ই-ভিসা সিস্টেম উন্নয়ন রয়েছে।
এর বাইরে মহাপরিকল্পনায় পর্যটক আকর্ষণের জন্য হেলিপোর্ট নির্মাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং আবাসন সুবিধা বাড়ানোসহ বিভিন্ন রকমের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এই পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটন সেবার মান বাড়ানো, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক আকর্ষণগুলোর প্রচার, পর্যটকদের জন্য একটি নিরাপদ এবং অতিথিপরায়ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। মহাপরিকল্পনায় সারাদেশে এক হাজার ৪৯৮টি ট্যুরিজম রিসোর্স বা পর্যটন সম্পদ চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া মার্কেট পটেনশিয়াল বা বাজার সম্ভাবনা, স্বতন্ত্রতা, সম্পদের প্রাপ্যতা এবং স্থায়িত্বের ভিত্তিতে এগুলো ১৪টি থিমে মূল্যায়ন করা হয়েছে।
মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সাল নাগাদ প্রায় ৫৫ লাখ বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ খাতে প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। নতুন প্রণয়ন করা পরিকল্পনায় ১০টি পর্যটন ক্লাস্টার তৈরির জন্য ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ চাওয়া হয়েছে।
রাস্তা, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তার মতো অবকাঠামোগত সুবিধা উন্নয়নে ১০৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সরকার। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা মূলত বিনিয়োগ করবে তারকা হোটেল, রিসোর্ট, বিনোদন পার্কসহ অন্য বিলাসবহুল সুবিধা নির্মাণে।
যদিও এখন দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে কত সংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন তার সঠিক তথ্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের কাছে নেই। তাহলে কীসের ভিত্তিতে ওই মহাপরিকল্পনার সুবিধার কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অংশীজনরা।
জানতে চাইলে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) মোহাম্মাদ ইউনুছ জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। এখন এই মহাপরিকল্পনা কীসের ভিত্তিতে করা হচ্ছে, তা ট্যুরিজম বোর্ডই বলতে পারবে। তবে পর্যটন মহাপরিকল্পনা তৈরির শুরু থেকে খামখেয়ালি করেছে ট্যুরিজম বোর্ড। ফলে বারবার এ পরিকল্পনার খসড়া তৈরিতে দেরি হয়েছে। একাধিকবার তারা খসড়া জাতীয় পর্যটন পরিষদে জমা দিলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। তা পর্যালোচনার জন্য ফেরত দেওয়া হয়েছে বলে জানি। এখন তা কী অবস্থায় আছে তা জানা নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, `ট্যুরিজম বোর্ডের এই মহাপরিকল্পনার মূল্যায়ন কমিটিতে আমি ছিলাম। কমিটির প্রথম দুটি সভায় ট্যুরিজমের সীমাবদ্ধতা বা সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে তাদের অনেক পরামর্শ দিয়েছি। এগুলো তাদের নোট নিতে বলেছি। তখন তারা এ পরামর্শগুলো লিখিত দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা কোনো সম্মানি বা চুক্তি করতে চায়নি। অথচ ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটা নেওয়া হয়েছিল। পরের মিটিংয়ে তারা ডাকলেও আর যাওয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মূল্যায়ন কমিটির সভায় অংশগ্রহণ করে দেখেছি, এই খাতে মহাপরিকল্পনা করার মতো আমাদের ট্যুরিজমে তেমন এক্সপার্ট নেই। বিদেশের যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ পেয়েছিল, তারাও নিয়মিত আসতো না। অথচ এত বড় একটি প্রকল্প এক-দুজন লোক দিয়ে করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তীসময়ে এই মহাপরিকল্পনা কতদূর এগোতে পেরেছে তা জানা নেই।’
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ট্যুরিজম নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল জানিয়ে অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন বলেন, ‘ওই মহাপরিকল্পনাটি ছিল শ্রীলঙ্কার। যা তৈরি করেছিল ইংল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান। এটির নামটা পরিবর্তন করে বাংলাদেশ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেখানে ট্যুরিজম নিয়ে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু পরে আর তা বাস্তবায়ন হয়নি। এখন সরকার ট্যুরিজম নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা করছে, সেটা বাস্তবসম্মত হলে এই খাত এগিয়ে যাবে।’
এমএমএ/এএসএ/জিকেএস