দেশজুড়ে

বাঁওড়ের মাছ লুট করতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাট্টা

যশোরের চৌগাছা উপজেলার বল্লভপুর বাঁওড় জলমহালটির ইজারাদার বল্লভপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা নিয়ে বাঁওড়টি চাষ করছেন সমিতির সদস্যরা। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বাঁওড়র নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা। একইসঙ্গে টানা চার মাস ধরে বাঁওড়ের মাছ লুট করে আসছে চক্রটি। তারা প্রায় এক কোটি টাকার মাছ লুট করেছেন।

Advertisement

গত ১২ ডিসেম্বর সমিতির সদস্যরা মাছ ধরতে বাঁওড়ে নামলেও স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের বাঁধায় তা বন্ধ হয়ে গেছে। সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী হিন্দুপাড়ায় মহড়া দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি, মাছ ধরার জাল ও নৌকা কেড়ে নেওয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সমিতির সদস্যরা।

সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চৌগাছা উপজেলার বল্লভপুর বাঁওড়টি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ছয় বছর মেয়াদে ইজারা নিয়ে চাষ করছেন বল্লভপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা। কিন্তু গ্রামের একটি চক্র জোর করে বাঁওড়টি দখলের পাঁয়তারা করছেন। স্থানীয় সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জিন্নাত আলী, আওয়ামী লীগ নেতা আইজেল হক, মিজানুর রহমান ও তার সহযোগীরা গত জুন মাস থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ছত্রচ্ছায়ায় বাঁওড়টি দখলের চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ওই চক্রটি বিএনপির নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় রাতারাতি বিএনপির কর্মী বনে যায়।

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জিন্নাত আলীর ছেলে আসাদুজ্জামান আসাদ স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক হওয়ায় তার দাপট দেখাতে শুরু করেন জিন্নাত আলী, আইজেল হক ও মিজানুর রহমান গংরা। জিন্নাত আলী আওয়ামী লীগের নেতা হলেও তার আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই সম্পর্ক ব্যবহার করে রাতারাতি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জিন্নাত আলী ও তার সহযোগীরা। তাদের নেতৃত্বে ৬ আগস্ট থেকে বল্লভপুর বাঁওড়ের মাছ লুট শুরু হয়। যা এখনো চলছে। চার মাস ধরে বাঁওড়ের মাছ লুট করায় সমিতির সদস্যদের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ও জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সম্মতি ও প্রশাসনকে অবহিত করে গত ১২ ডিসেম্বর বাঁওড়ের মাছ শিকারের সিদ্ধান্ত নেন সমিতির সদস্যরা। কিন্তু ওইদিন সকালে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আসাদের অনুসারী ও আত্মীয় বিএনপির কর্মী রুস্তম আলী, মশিয়ার রহমান, হুজুর আলী, সেলিম, মনিরুজ্জামানসহ ১৫-২০ জন সমিতির সদস্যদের মাছ ধরতে বাধা দেন। একপর্যায়ে নৌকা ছিনিয়ে নিয়ে যান তারা। ওইদিন পুলিশের হস্তক্ষেপে পরে তারা নৌকা ফেরত দেন। পরে রাতের আঁধারে তালা ভেঙে চারটি নৌকা নিয়ে যায় জিন্নাত আলী ও আইজেল হকের ক্যাডার বাহিনী। বল্লভপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্যরা জানান, গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে বল্লভপুর গ্রামের বাসিন্দা আইজেল হক, সাহাঙ্গীর, সাবদার, মনিরুল, আসাদুল, আলম বিশ্বাস, সুজন, তবি, রশিদ, হাসান, সাদুল্লা, জাহাঙ্গীর, সুকুর মল্লিক, গহর মল্লিক, শহর মল্লিকসহ ২৫-৩০ জন জোর করে বাঁওড়ে মাছ ধরতে নামেন। পরে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পালিয়ে যান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আইজেল হককে আটক করলেও মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এসময় সমিতির তিনটি নৌকা পুলিশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন সমিতির সদস্যরা বাঁওড়ে মাছ ধরতে নামলে আইজেল হক, জিন্নাত আলীর লোকজন দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে হিন্দুপাড়ায় মহড়া দেয়। এসময় তারা বাড়িতে গিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। একপর্যায়ে বাঁওড়ে নেমে সদস্য ও শ্রমিকদের জিম্মি করে জাল ও একটি নৌকা কেড়ে নিয়ে যান তারা।

তারা আরও জানান, তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালেও তেমন কোনা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর পুলিশের হস্তক্ষেপে ছিনতাই হওয়া জাল ও একটি নৌকা উদ্ধার করে সমিতির সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে এখনো সমিতির সদস্যদের বাঁওড়ে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা।

এ বিষয়ে চৌগাছা বিএনপির সভাপতি এমএ সালাম বলেন, সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয়। আমরা চাই এটার সঠিক তদন্ত হয়ে বিচার হোক।

জানতে চাইলে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আমি ন্যায়ের পক্ষে। দুদিন আগে চৌগাছা থানার ওসিকে বলেছি, নৌকা ও জাল উদ্ধার করে ফেরত দিতে। একইসঙ্গে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে যে নির্যাতন করবে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। আমার পিতা হলেও মাফ করা হবে না।’ এ বিষয়ে চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পায়েল হোসেন বলেন, বাঁওড়ের মাছ লুট বা ডাকাতি মামলা থানায় হয় না। মামলা আদালতের মাধ্যমে করতে হয়। বাঁওড়ে এখন স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। দুই পক্ষকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বলা হয়েছে।

Advertisement

মিলন রহমান/এসআর/এএসএম