ফিচার

চাকরি-সংসার সামলেও যেভাবে সফল উদ্যোক্তা হলেন কান্তা

বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার চাঁপাপুরের মেয়ে কান্তা চক্রবর্ত্তী। মাস্টার্স শেষ করার পর মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের জেলা অফিসে কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর পদে চাকরি পান। চাকরি ও সংসার সামলে উদ্যোক্তা হয়ে যান কান্তা।

Advertisement

বর্তমানে তিনি হাতে তৈরি গহনার একজন সফল উদ্যোক্তা। আর এ উদ্যোগ থেকেই মাসে তিনি আয় করেন ৩০-৪০ হাজার টাকা। কান্তা চক্রবর্ত্তীর এগিয়ে চলা, প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজেদুর আবেদীন শান্ত-

উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্প জানতে চাই?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমার উদ্যোক্তা জীবনের শুরুটা ছিল গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরেই। নিজের পাশাপাশি অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ছিল উদ্যোক্তা জীবনে আসার মূল লক্ষ্য। চাকরির বাজারে চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে যেন নিজে কিছু করতে পারি। সেই ভাবনা থেকেই আসলে এই যাত্রা শুরু হয়।

Advertisement

আমি সবসময়ই হাতে তৈরি জিনিসের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম। শুরুটাও করেছিলাম কয়েকজন ফ্রেন্ড মিলে হাতে তৈরি বুটিকস পণ্য নিয়ে। তবে সেই টিমটা ভেঙে যাওয়ায় বিরতি দিয়ে আবার কাজ শুরু করি। কী নিয়ে কাজ করবো, সেটা ভাবতে ভাবতেই ফেসবুকে বিভিন্ন গহনার পোস্ট আসতে দেখে একদিন মনে হলো, আমি হাতে তৈরি গহনা নিয়েই কাজ শুরু করতে পারি।

প্রথমে নিজের জন্য কিছু গহনা অনলাইন থেকে কিনে সেগুলো খুলে দেখি, সেখান থেকে কিছু আইডিয়া এবং ইউটিউব থেকে কিছু আইডিয়া নিয়ে আমি প্রথম গয়না বানাই। তখন আশেপাশের মানুষগুলো প্রশংসা করতে শুরু করলো। আর আমি গহনা তৈরিকে ব্যবসায় রূপ দিলাম। সেখান থেকেই ২০১৯ সালে ‘Klaze’ নামে আমার উদ্যোগের যাত্রা শুরু।

হাতে তৈরি গহনা নিয়ে কেনো কাজ করছেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: হাতে তৈরি গহনার মধ্যে একটি ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে, যা মেশিনে তৈরি গহনায় পাওয়া যায় না। আমার কাছে এটি কেবল একটি পণ্য নয়, বরং সৃজনশীলতার প্রকাশ। মনের সব রং ঢেলে আমি গহনা বানাই। এছাড়া হাতে তৈরি গহনা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই, যা আমার মূল দর্শনের সঙ্গে মেলে।

Advertisement

চ্যালেঞ্জ ছিল কেমন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমি যেহেতু একজন উদ্যোক্তার পাশাপাশি চাকুরিজীবী, তাই আমার জন্য চাকরি ও ব্যবসার মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখা কঠিন ছিল। শুরুতে খুব সীমিত মূলধন নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। মাত্র ১৮০০ টাকা মূলধন নিয়ে আমি এই কাজ শুরু করি।

অন্যদিকে নিজের উদ্যোগের নামটা সঠিকভাবে প্রচার করা ও নতুন নতুন ক্রেতার আস্থা অর্জন করা সময়সাপেক্ষ ছিল। এছাড়া ইম্পোস্টার সিনড্রোম ও নিজেকে নিয়ে সন্দেহ কাটিয়ে ওঠা একটা বড় মানসিক চ্যালেঞ্জ ছিল।

চাকরির পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন কি না?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: অবশ্যই! অফিসের দীর্ঘ সময় কাজের পরে ব্যবসার জন্য সময় বের করা অনেক কঠিন ছিল। পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা মেটানোও চ্যালেঞ্জিং। অনেক সময়ই মনে হতো, আমি যথেষ্ট করছি না। অনেকবার মনে হয়েছে আমি হয় তো পারব না, কিন্তু ধৈর্য ধরে পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে গেছি।

আরও পড়ুন ৪০ বছরের দাম্পত্যে ১২ বার বিচ্ছেদ, অতঃপর যে রেস্তোরাঁয় ১ কাপ চা লাখ টাকা

পাশাপাশি আর কী নিয়ে কাজ করছেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমি বর্তমানে বিভিন্ন স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং দিচ্ছি, যেমন- গহনা তৈরির প্রশিক্ষণ, বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বিনির্মাণ প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছি।

কেনো মানুষ আপনার পণ্য কিনবেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমার পণ্যের বিশেষত্ব হলো প্রতিটি পণ্য হাতে তৈরি, যা ইউনিক ও পরিবেশবান্ধব। গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কাস্টমাইজড পণ্য তৈরির সুযোগও দিচ্ছি। ফলে গ্রাহকরা একটি ব্যক্তিগত টান অনুভব করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের পণ্যের ডিজাইনেও পরিবর্তন নিয়ে আসি। যা ক্রেতা পছন্দ করেন।

আপনিতো হাতে তৈরি গহনার প্রশিক্ষণও দেন। প্রশিক্ষণের বর্তমান অবস্থা কি?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: বর্তমানে আমি স্থানীয় পর্যায়ে ছোট ছোট ব্যাচ তৈরি করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। অনলাইনেও একটি ব্যাচ কমপ্লিট করেছি। আমার লক্ষ্য হলো, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা ও তাদের সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো। আমার প্রশিক্ষণগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

কতজনকে এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: এ পর্যন্ত আমি প্রায় ১০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর মধ্যে অনেকেই তাদের নিজস্ব উদ্যোগ শুরু করেছেন, যা আমাকে অত্যন্ত আনন্দিত করে। অনেকে আমার সাথেও কাজ করছেন।

প্রশিক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করা ও অনলাইনে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা। যেখানে যে কেউ সহজেই প্রশিক্ষণ নিতে ও নিজস্ব উদ্যোগ শুরু করতে পারবে। যার জন্য দূরত্ব কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

আপনার অনুপ্রেরণায় কে ছিলেন?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমার পরিবার আমার অনুপ্রেরণা, কাজের ক্ষেত্রে ধ্রুব’র খেলাঘরের ফাউন্ডার সেই সময়ের ছোট্ট ধ্রুবর সৃজনশীলতা আমাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করেছে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে অনেক নারী উদ্যোক্তার গল্প আমার জন্য প্রেরণার উৎস হয়েছে।

উদ্যোগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: আমার স্বপ্ন ‘Klaze’কে এমন একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করা যা শুধু বাংলাদেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হবে। পাশাপাশি আরও অনেক নারীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিতে চাই। আগামী বছরে ক্লেজের একটি নিজস্ব প্রডাকশন হাউজ তৈরি করতে চাই, যেখানে একাধিক নারী একত্রে কাজ করতে পারবে।

আপনি তো একজন সফল উদ্যোক্তা? তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

কান্তা চক্রবর্ত্তী: সফলতা একদিনে আসে না ও ব্যক্তিভেদে সফলতার সংজ্ঞাও ভিন্ন। আমি যেহেতু ক্লেজের হাত ধরে কিছু নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি, কিছু মানুষের বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ভরসার জায়গা হতে পেরেছি, এতেই গর্ববোধ করি। তবে বিশ্বাস করি আমাকে আরও অনেক কাজ করতে হবে, নিজের জন্য, সমাজের জন্য ও নারীদের জন্য।

তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো, স্বপ্ন দেখুন ও সেটাকে বিশ্বাস করুন। আর অবশ্যই কাজ শুরু করুন। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করবেন না। ব্যর্থ হলে ভেঙে না পড়ে তা থেকে শিখুন ও কখনো হাল ছাড়বেন না। টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখুন, এটা খুব জরুরি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করুন। সবচেয়ে বড় কথা, নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। নিজেকে নিজে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুললে আপনি অবশ্যই সফল হবেন।

জেএমএস/এএসএম